সিরাজগঞ্জ: ‘বাসের চালক-হেলপাররা আপুকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। হত্যাকারীরা যেন এমন শাস্তি পায়, যা দেখে আর কোনো পুরুষ কোনো মেয়ের প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ না করে।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর হত্যার শিকার কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপার ছোট বোন পপি।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের আসানবাড়ি গ্রামের সাধারণ পরিবারের সংগ্রামী প্রতিভাবান মেয়ে ছিল রূপা। মানুষরূপী কয়েকজন নরপশুর নির্মম নির্যাতনে মারা যাওয়ার পর থেকেই তার পরিবারে চলছে আহাজারি।
আদরের বোনকে হারিয়ে বার বার শোকে মুর্ছা যাচ্ছেন দুই বোন পপি ও জিয়াসমিন।
স্বজন ও প্রিয়জনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। তাদের আহাজারিতে এলাকাবাসীও ধরে রাখতে পারছেন না চোখের পানি। আর মেয়েকে হারিয়ে শোকে কাতর মা এরই মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি।
জানা গেছে, নিহত রূপা তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের আসানবাড়ি গ্রামের মৃত জিলহাস প্রামানিকের মেয়ে। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে রূপা তৃতীয়। রূপার বাবা আগেই মারা গেছেন।
এদিকে মেয়ের এমন মৃত্যুর খবরের শোকে কাতর বিধবা মা হাসনা হেনা অসুস্থ হয়ে রোববার থেকে তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রয়েছেন।
ঘটনার ৬ দিন পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রূপার লাশ পরিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে। এর আগে বিকেলে টাঙ্গাইলের কেন্দ্রীয় কবরস্থান থেকে লাশ তুলে তার ভাইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রূপার বড় বোন জিয়াসমিন খাতুন কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, আকাশ ছোয়া স্বপ্ন ছিল বোন রূপার। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে বড় উকিল হবে। কিন্তু মানুষরূপী একদল হায়েনা রূপার সে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
রূপার ছোট বোন পপি খাতুন জানান, দুইবোন একসঙ্গে একটি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। রূপা থাকত শেরপুরে। আর আমি থাকতাম গাজীপুরে।
কান্নাজড়িত কন্ঠে পপি বলেন, বাসের চালক-হেলপাররা আপুকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। হত্যাকারীরা যেন এমন শাস্তি পায়, যা দেখে যেন আর কোনো পুরুষ কোনো মেয়ের প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ না করে।
বার বার চোখের পানি মুছতে মুছতে স্মৃতিচারণ করে পপি বলেন, ‘বাবা মারা যাবার পর আপুই আমাদের সবকিছু দেখভাল করত। এখন আপু নেই, আমরা কী করে বাঁচব?’
রূপার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী জানান, ‘আপু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। তাহাজ্জুতের নামাজ পড়তেন। এত ভালো একজন মানুষকে এভাবে মানুষ মেরে ফেলবে কল্পনাই করা যায় না। যারা আপুকে হত্যা করেছে তারা মানুষ নয়, মানুষরূপী জানোয়ার। তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’
এদিকে রূপা নিখোঁজের পর থেকেই তার মা হাসনা হেনা শোকে কাতর হয়ে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বুধবার দুপুরে তাকে ভর্তি করা হয়েছে তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি বলেন, রূপার বড় ইচ্ছে ছিল মস্তবড় উকিল হবে। সমাজসেবা করবে। ও খুব কষ্ট করে নিজের লেখা পড়ার খরচ চালাত। ছোট বোনকে ভালো ঘরে বিয়ে দেবে, ছোট ভাইকে প্রতিষ্ঠিত করবে বলে স্বপ্ন ছিল। কিন্তু মানুষরূপী কিছু অমানুষ রূপাকে মেরে ফেলল।
তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি- আমার সোনার টুকরা মেয়েটাকে যারা নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের কঠিন বিচার যেন আমি জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারি।
প্রসঙ্গত, রূপাকে চলন্ত বাসে নির্যাতনের পর হত্যা করে বাসটির কয়েকজন শ্রমিকরা।
এ ঘটনায় পুলিশ ওই পরিবহনের ৫ শ্রমিককে গ্রেফতার করেছে। তারা সবাই দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিজ বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ি গ্রামে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে রূপার লাশ। এ সময় এলাকার নারী-পুরুষ এ হত্যার বিচারের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন।
টাঙ্গাইল থেকে বাসে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে মধুপুর এলাকার পঁচিশ মাইল নামক স্থান হতে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয় তাড়াশের তরুণী রূপা (২৭) কে। মৃত্যুর পর বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন তার লাশ দাফনও করা হয়েছিল। কিন্তু ৬ দিন পর রূপার লাশ পৌঁছে পরিবারের কাছে। দাফন হয় পারিবারিক কবস্থানে তার বাবার কবরের পাশেই।
এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে রূপার লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স আসানবাড়ি গ্রামে এসে পৌঁছালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় স্বজনদের আহাজারিতে আসানবাড়ি গ্রামের বাতাস ভারী ওঠে। পরে আসানবাড়ি গ্রামের সোহরাবের পুকুর পাড়ে রূপার জানাজা সম্পন্ন হয়।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে রূপাকে বাবার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
এর আগে বিকেলে তাড়াশ ইউএনও এসএম ফেরদৌস ইসলাম পরিষদের পক্ষ থেকে রূপার পরিবারকে ১০টাকা অনুদান প্রদান করেন।
ওই তরণীর মৃত্যুতে হতবাক হয়ে দিশেহারা হয়ে পরেছেন পুরো পরিবার। সকলেই রূপা হত্যার বিচারের দাবি করেছেন। সবাই চাইছে আসামি পাঁচজনেরই ফাঁসি।