মিয়ানমারে মরিয়া ‘অন্ধকার বাহিনী’ ফের সেনা বিদ্রোহের শঙ্কা দড়ির ওপর হাঁটছেন সুচি * প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর দখলে  

 121014Stilommandioরোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে মিয়ানমারে ফের সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অং সান সুচিকে ফাঁদে ফেলে দেশটির ব্যাপক ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী ফের ক্ষমতা দখল করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। মিয়ানমারের ৭০ বছরের ইতিহাসে ৫৫ বছরই শাসন করেছে সেনাবাহিনী। দেশটিতে আবার সেনাশাসন ফিরতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে টাইম ম্যাগাজিন।

২০১৫ সালে একটি অবাধ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পর অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ক্ষমতায় এলেও সেনাবাহিনী এখনও দেশটির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সংসদে ২৫ ভাগ আসন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তারা। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তবিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলো এখনও সেনাবাহিনীর দখলেই রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব মন্ত্রণালয়ের ওপর দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেতা সুচির কোনো ক্ষমতাই নেই।20150707_lady-police002

রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে সেনাবাহিনী। ক্ষমতায় টিকে থাকতে সুচি প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। চাইলেও সেনাবাহিনীর ক্ষমতার লাগাম টানার ক্ষমতা তার নেই। তাই রাখাইনে গত ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের’ কথিত হামলার পরপরই ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন্স’-এর অনুমতি দেয়া হয় সেনাবাহিনীকে। সমালোচকরা বলছেন, সুচিকে আরও দুর্বল ও রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু করতে সেটি ছিল সামরিক বাহিনীর নীলনকশার একটি অংশ। এরপর সেখানে সেনাবাহিনী পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে Myanmar police women9চলেছে। খোদ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র বুধবার স্বীকার করেছেন যে, রাখাইনের ৪৭১টি রোহিঙ্গা গ্রামের ১৭৬টি তথা ৪০ ভাগ গ্রাম এখন জনশূন্য। গ্রামগুলোতে রোহিঙ্গাদের বাস ছিল।

এ পরিস্থিতিতে সেনা অভিযানের নিন্দা জানানোর জন্য সুচির ওপর চাপ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং তারই একসময়ের ঘনিষ্ঠজনরা। তবে সুচি তাতে কর্ণপাত করছেন না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তাকে ফের ক্ষমতাচ্যুত করা হতে পারে। সেনারা তাকে দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দি রেখেছিল।images

টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশটির ক্যাথলিক ধর্মগুরু কার্ডিনাল চার্লস মং বো। ২০১৫ সালে তাকে মিয়ানমারের প্রধান ক্যাথলিক ধর্মগুরু পদে নিয়োগ দেন পোপ ফ্রান্সিস। মিয়ানমার থেকে তিনিই প্রথম ক্যাথলিক ধর্মগুরু যাকে কার্ডিনাল পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কাডির্নালরাই ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ পদে বাছাই করে থাকেন।

টাইম ম্যাগাজিনকে বো বলেন, সুচির অবস্থান নড়বড়ে। মিয়ানমারে গণতন্ত্র এখনও ভঙ্গুর। তিনি বলেন, সুচি ২০১৫ সালের নির্বাচনে ভূমিধস জয় পেলেও এখন ‘দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছেন’। সেনাশাসন ফেরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ‘অন্ধকার বাহিনী (ডার্ক ফোর্স)’।

বো বলেন, ‘একটি ভুল পদক্ষেপেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন এবং মিয়ানমারে গণতন্ত্রের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, মিয়ানমারের ইতিহাসে সেনাবাহিনী তিনবার গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরেছে।’

দৃশ্যত সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা থেকেই সুচি রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে হয় নীরব থাকেন, না হয় সেনাবাহিনীর সমর্থনেই কথা বলেন। বেসামরিক রোহিঙ্গাদের গণহত্যা চালিয়েও সেনাবাহিনী দাবি করে, তারা সন্ত্রাসীদের হত্যা করছে। সুচিও তাদের বক্তব্যই সমর্থন করে থাকেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনাবাহিনীর সমান্তরালে অবস্থান নিয়ে সুচি সারা দুনিয়া থেকে যেভাবে নিন্দা কুড়াচ্ছেন, যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন তাতে তার অবস্থান উল্টো আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। মিয়ানমারের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী এখনও তাকে সমর্থন দেয়। তবে তিনি ক্ষমতাহীন নেত্রী- এ ধারণা জনমনে বদ্ধমূল হলে তাতে সেনাবাহিনীর অবস্থানই পাকাপোক্ত হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম এক নিবন্ধে লিখেছেন, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা আরোহণ হচ্ছে বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো। ক্ষমতা রাখাও বিপজ্জনক, ছাড়াও বিপজ্জনক। মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং দীর্ঘকালব্যাপী আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটাতে বাধ্য হয়েছে। অং সান সুচির জন্য সামনের সময়টি বিপজ্জনক এবং স্পর্শকাতর।

তিনি লিখেছেন, সেনাবাহিনী বাধ্য হয়ে বেসামরিক সরকারকে গ্রহণ করলেও তারা সময়ান্তরে মিসরের সেনাপ্রধান আবুল ফাত্তাহ আল সিসির মতো সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে।

টাইম ম্যাগাজিনকে কার্ডিনাল বো বলেন, ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা দেশটির চেয়েও বড়। বিশ্বজুড়ে ইসলাম ভীতি ও ক্ষমতাধর দেশগুলোতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করলেও শাস্তি না হওয়ায় অনেক দেশে ইসলাম বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমার কষ্ট লাগে যে কিছু লোক উগ্র জাতীয়তাবাদী অনুভূতি ছড়াচ্ছে।’ রাখাইনের লোকজন চরম দুর্ভোগ, অবহেলা ও দুর্ব্যবহারের শিকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মিয়ানমারে খ্রিস্টানরা রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বললেও দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে- দেশটির বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বরং রোহিঙ্গা দমনে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। অনেকেই বলেন, এর কারণ তাদের উগ্র ইসলাম বিদ্বেষ।

বৃহস্পতিবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সুচির শাসনেও ইসলাম বিদ্বেষ প্রচার করে বেড়াচ্ছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। বিবিসির সাংবাদিক ফার্জাল কিয়েন মান্দালয়ের কিম উন মিন জি মঠে আট সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলেন। তাদের একজন আইন্দার সাক্কা বিউইনথা বলেন, ভারতের দিকে তাকান। সেখানে ইসলামী অনুপ্রবেশকারীরা লোকজনকে মুসলিম হতে বাধ্য করেছে। তার কথার অর্থ হল- রাখাইন যাতে মুসলিম জনপদ না হয় সে জন্য তারা রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে সহায়তা দিচ্ছে। উগ্র বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মা বা থা বলেন, বাঙালি (রোহিঙ্গা) ইস্যুতে সুচি সঠিক পথেই আছেন। তিনি সঠিক কথাই বলছেন।

ফার্জাল কিয়েন লিখেছেন, বেশিরভাগ বৌদ্ধের মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো সহানভূতি দেখা যাচ্ছে না।

তিনি লিখেছেন, রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার ও মানবিকতার ট্র্যাজেডি আসন্ন। চলমান দমন-পীড়ন আরও বেশ কিছুদিন চলতে পারে। তবে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের যে মুখোশ রাখাইনে উন্মোচিত হয়েছে তা দেশটির ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।