রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচার শক্তি প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৮টি দেশ মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মিন অংসহ সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইউরোপে সব ধরনের আমন্ত্রণ স্থগিত করে দিয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের সাথে ইইউ’র সামরিক সহযোগিতা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নে ব্যবহার করা যায়, এমন সব অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি মিয়ানমারে বিক্রির ওপর আগে থেকে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। এতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরো পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি ইইউ বিবেচনায় রাখবে। আর পরিস্থিতির অগ্রগতি হলে ইইউ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে প্রস্তুত রয়েছে।
আজ সোমবার লুক্সেমবার্গে ইইউ পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকে (ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশেন্স) এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ইইউ’র হাই রিপ্রেসেন্টেটিভ ফেডারিকা মুগিরিনিসহ এ বৈঠকে জোটের সব দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে সর্বসম্মত প্রস্তাবে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর। সেখান থেকে নির্বিচার গুলিবর্ষণ, ল্যান্ড মাইন পুতে রাখা, যৌন নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা এখনই বন্ধ করতে হবে। সহিংসতা ও ভীতির কারণে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ, যাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা, পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতো অধিক সংখ্যক মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বহিষ্কার করার পরিকল্পিত পদক্ষেপের শক্তিশালী ইঙ্গিত বহন করে। উদ্বাস্তুদের নিরাপদ ও মর্যাদার সাথে ঘরে ফিরতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো ও সংবাদ মাধ্যমের প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
প্রস্তাবে উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র, বিশেষ করে বাংলাদেশের সাথে সংলাপে বসার জন্য মিয়ানমারকে উৎসাহিত করেছে ইইউ। কঠিন এই পরিস্থিতিতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার জন্য এতে বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক তদন্তকে মিয়ানমার ভয় পায় না বলে দেশটির রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর অং সান সু চি গত ১৯ সেপ্টেম্বর যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য অপরাধের সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার সু চি’র প্রতিশ্রুতিকে ইইউ স্বাগত জানায়। শিশুদের ওপর আক্রমণসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগগুলো পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধান মিশনের সাথে মিয়ানমারের সহযোগিতা করা উচিত। কালবিলম্ব না করে এই মিশনকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে পূর্ণ, নিরাপদ ও বাধাহীন প্রবেশাধিকার দেয়া প্রয়োজন।
প্রস্তাবে বলা হয়, মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উন্নয়ন, শান্তি, জাতীয় সংহতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতি ইইউ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির নাগরিকত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুসহ রাখাইন রাজ্যের সঙ্কট নিরসনে আনান কমিশনের সুপারিশগুলো দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাবে ইইউ। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার সরকারের আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি গঠনকে ইইউ স্বাগত জানায়।
এতে বলা হয়, মিয়ানমারের কাচিন ও শান রাজ্যে সঙ্ঘতের কারণে লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও ইইউ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। মিয়ানমার ও জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামের সাথে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এবং গণতান্ত্রিক উত্তরনের প্রক্রিয়ায় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইইউ কাজ করে যাবে। এজন্য আগামী ২০ ও ২১ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে অনুষ্ঠেয় আসেম পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ইইউ সক্রিয় থাকবে। মিয়ানমার সরকারের সাথে গঠনমূলক সংলাপ এবং এশিয়ার সব অংশীদারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হবে। এ প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আশিয়ান এবং আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোকে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহ দেবে ইইউ।