ভারতীয় নর্তকীদের জীবনের অন্ধকার অধ্যায়

বর্তমানে ভারতে বিয়ে কিংবা আনন্দোৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে নাচের অনুষ্ঠান। নাচ ছাড়া এখন বলতে গেলে যে কোন উৎসব অপূর্ণ থেকে যায়। এই নাচের অনুষ্ঠানের প্রাণ হলেন লাস্যময়ী নাচনেওয়ালিরা। রঙ্গিন আলোর ঝলকানিতে দুলতে থাকা দেহের কারুকাজে তারা মাতিয়ে রাখেন উৎসব। নানা রঙের আলোর তালে নেচে আনন্দ ছড়ানো এ নৃত্যশিল্পীদের জীবন আসলে কতটা আনন্দময়? টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ বিষয়ে উঠে এসেছে নানা তথ্য। এতে তুলে ধরা হয়েছে এক নতর্কী স্বপ্না চৌধুরীর কথা।

তার নামের সঙ্গেই স্বপ্ন জড়ানো। বিগবস নামের টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন সম্প্রতি। এসেছেন একটা বিরাট অনুষ্ঠানে নাচতে। মঞ্চের সামনের জনসমুদ্রের দিকে উদ্দেশ্য করে হাত নাড়তেই জনতা উল্লাস করে উঠলো। নাচ শুরু করলেন তিনি। নাচের তালে তালে তার দেহের মোহনীয় ভঙ্গিতে বিভোর হয়ে যাচ্ছিলো সবাই। মুহুর্মুহু হাততালি পড়তে থাকে। বাড়তে থাকে সঙ্গীতের লয়। ক্লিক… ক্লিক… ক্লিক। শত শত মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ক্যামেরাবন্দি হতে থাকেন স্বপ্না। হরিয়ানার মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া স্বপ্না নাচের জগতে পা রাখেন তার পিতার মৃত্যুর পর। ২৭ বছর বয়সী এই নর্তকীর বৃহ¯পতি এখন তুঙ্গে। ‘সলিড বডি’ নামের একটি মিউজিক ভিডিও দিয়ে প্রথম দর্শকের নজর কাড়েন তিনি। এর পরে আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। তার মিউজিক ভিডিও এখন তুমুল দর্শকপ্রিয়। ‘যাবার বারতা’ নামের মিউজিক ভিডিওটিই ইউটিউবে ৭১ লক্ষ বার দেখা হয়েছে! কিন্তু, স্বপ্নার মতো নর্তকীদের এই খ্যাতি আর চাকচিক্যের আড়ালে রয়েছে নিষ্ঠুর এবং নোংরা এক জগৎ। যে জগতে তারা পদে পদে শিকার হন লালসা এবং ভয়াবহতার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্বপ্না আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। সে যাত্রায় অবশ্য তার এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর পেছনের কারণ এখনো অজ্ঞাত। যদিও সে সময় হাসপাতালের বেডে শুয়ে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে অত্যন্ত নোংরা এবং আজেবাজে কথা প্রকাশ হওয়ায় তিনি মানসিক অবসাদে ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি বলেন, আমার মানসিকতা ভংগুর হয়ে গিয়েছিলো এবং আমি সহ্যসীমার দারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম। অবশ্য স্বপ্নার মতো ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো না দিল্লির নর্তকী হারশিতা দাহিয়ার। তিনি মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচতে পারেন নি। দুলাভাইয়ের নামে ধর্ষণের মামলা করায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাঁচতে পারেন নি ২৫ বছর বয়সী কুলবিন্দার কৌর-ও। গত বছরের ডিসেম্বরে একটি অনুষ্ঠানে নৃত্যরত অবস্থায় এক মদ্যপের গুলিতে নিহত হন পাঞ্জাবের এই নর্তকী। নাচের চকমকে জগতের আড়ালে এই হলো সেখানকার নৃত্যকর্মীদের জীবনের বাস্তবতা। তারা কখনো উদযাপন অনুষ্ঠানের বন্দুকের গুলির মুখে পড়েন, কখনোবা মাতালের কবলে পড়েন সম্ভ্রম হারাবার ভয় নিয়ে, কখনোবা কামনালিপ্সু আয়োজকদের নোংরা যৌন হয়রানির শিকার হন। এসব ভয়াবহতা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুম্বইয়ের ড্যান্স বার স¤পর্কে লেখা বই ‘বিউটিফুল থিং: ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব বম্বেস ড্যান্স বার’-এর লেখিকা সোনিয়া ফালেইরো বলেন, ড্যান্স বারে যাওয়া অনেক পুরুষই মনে করেন, নর্তকীদের শরীরের ওপর তারা চাইলেই অধিকার খাটাতে পারে। কম আয়ের অথবা নিচু গোত্রের এসব নর্তকীকে তারা অর্পিত স¤পত্তি ভেবে বসে। তারা ভাবে, চাইলেই এদের সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। বিহারে প্রকাশ্য মদপান নিষেধ করার পর থেকে প্রাইভেট ব্যাচেলর পার্টির সংখ্যা হুঁ হুঁ করে বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে পার্টি শেষে রাতভর উদ্দাম যৌনতা। পাটনায় বসবাস করা জেসমিন নামের ২০ বছর বয়সী এক নর্তকী জানিয়েছেন তার এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা। পাঁচ বছর ধরে নাচের পেশায় যুক্ত তিনি। বলেন, কিছুদিন আগে আমি এক বান্ধবীসহ মধ্যরাতে এক নাচের অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে যাই। সেখানে যাবার পর আমরা জানতে পারি যে, সেটি একটি প্রাইভেট পার্টি। আমরা সেখানে নাচতে অস্বীকৃতি জানাই। তখন অনুষ্ঠানের লোকেরা আমাদের বন্দুক দেখিয়ে হুমকি দিতে থাকে। তারা বলে, তোদের নাচতে হবেই। তা না হলে প্রাণে বাঁচবি না। অনেক চেষ্টা করে আমরা সেদিন কোনমতে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে আসি। এমনকি পালানোর পথে ওই দুর্বৃত্তরা আমাদের রিকশাকেও তাড়া করে। জেসমিন আরো বলেন, একটা সময় ছিলো যখন নাচের অনুষ্ঠান ছিলো আনন্দপূর্ণ। কিন্তু, এখন এখানে পদে পদে ফাঁদ পাতা থাকে। সনু সোনি নামের আরেক নর্তকী বলেন, কেউ এখন আর ইচ্ছা করে এই পেশায় আসে না। নিতান্ত দুর্ভাগারাই এখানের অন্ধকার জগতে আসে। হতভাগা সনু- যার সাথে তার আত্মীয় এবং সমাজ স¤পর্ক ছিন্ন করেছে নাচের অন্ধকার জগতের বাসিন্দা হবার অপরাধে, তিনি আরো বলেন, পুরুষের লোলুপ হাত থেকে বাঁচতে আমাদের নির্ভর করতে হয় নিরাপত্তা রক্ষীদের ওপর। এ নিয়ে আছে আরো বিস্তর অভিযোগ। প্রফেশনাল আর্টিস্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান পাটনা ধর্মেন্দ্র ভারতী বলেন, নাচের দলগুলোতে এখন যৌনকর্ম একটা স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সংস্কৃতির ধারক এসব সংগঠনগুলোতে এখন অশ্লীলতার জয়জয়কার। ব্যবসা বাড়ানোর লোভে এখন নাচের সঙ্গে যোগ হয়েছে অশ্লীলতা। যৌন উদ্দীপনা বাড়িয়ে তোলার উদ্দেশ্যে বানানো হচ্ছে শিল্পমানহীন কুরুচিপূর্ণ গান। ক্রমাগত এই অবক্ষয় নিয়ন্ত্রণে নেয়া হচ্ছে না কোন কার্যকর ব্যবস্থা। উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদের নামী একটি সাংস্কৃতিক দল গৌতম অর্কেস্ট্রা। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্ত গৌতম। তার মতে, অনুষ্ঠানগুলোতে এখন আর কেউ মানসম্মত গান চায় না। সবখানে এখন শুধু ধুমধাড়াক্কা গানের তালে উদ্দাম নাচ আর স্থূল অর্থের সুড়সুড়িমূলক গানের চাহিদা। এর প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে আয়োজকরা নাচের শিল্পীদের অশ্লীলতা শেখায়। চাহিদা যেমন, জোগান তো তেমনই হবে! হরিয়ানভি ফোক গানের বিখ্যাত শিল্পী ভগবতী ভরদ্বাজ বলেন, আমি গানের জগতে আসি কারণ এ ছাড়া আমার অন্য কোন পথ ছিলো না। ভালো চাকরি করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না আমার। ছিলো না অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কিংবা কোন নিরাপদ সংস্থানের ব্যাবস্থা। ভালো গান গাইতে পারায় আমার একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ালো মঞ্চে গান গাওয়া। ২৮ বছর বয়সী এই শিল্পী জাগরণে (ধর্মীয় অনুষ্ঠান) সূফী সঙ্গীত এবং নাচ দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতির কারণে তিনি নিজের গানের ধরনে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছেন। আধ্যাত্মিক সূফী গানের বদলে এখন তাকে গাইতে হচ্ছে কুরুচিমূলক নি¤œমানের গান। এর কারণ হিসেবে ভগবতী দুঃখভারাক্রান্ত মনে জানান, ৪-৫ বছরে শ্রোতাদের চাহিদা আমূল পাল্টে গেছে। বেড়ে গেছে অশ্লীলতার কদর। তাই জীবনধারণের তাগিদে বাধ্য হয়ে তিনি এসব গান গাইছেন। একটা সময় ছিলো যখন নাচ একটা পবিত্র শিল্প। এখন সেখানে ছেয়ে গেছে কুরুচি এবং অশ্লীলতা। শিল্পীরাও তাই বাধ্য হয়ে নৈতিক সত্তার জলাঞ্জলি দিয়ে বেঁচে আছেন হীনমন্যতার চাদর মুড়ে। তবে শখের বশে নয়, জীবনের প্রয়োজনে। চাকচিক্যের আড়ালে এই হল বর্তমান নর্তকীদের জীবনের অন্ধকার অধ্যায়।

Check Also

অন্তর্বর্তী সরকারকে ডি-স্ট্যাবিলাইজ করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে: ফারুকী

নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নানান ইস্যুতে প্রতিবাদের সুরে কথা বলেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই ছাত্র-জনতাকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।