ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: : বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুকে দ্বিতীয় দিন প্রায় সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গতকাল বুধবার বিকাল পৌনে ৫টায় দুদক কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল জাতীয় পার্টির এই সাবেক এমপিকে। তবে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেননি তিনি। মাথা নিচু করে চলে যান।
এদিকে , দুদক‘র জেরার মুখে অসুস্থ হয়ে পড়েন বেসিক ব্যাংক কেলেংকারির মূল হোতা আবদুল হাই বাচ্চু। ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের মুখে বেলা আড়াইটার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বেলা ২টার দিকে আবদুল হাই বাচ্চু অসুস্থ বোধ করায় দুদক কার্যালয়ে একজন চিকিৎসককে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য ডেকে আনা হয়। দুদকের মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক জ্যোতির্ময় চৌধুরী তাকে পরীক্ষা করে দেখেন। পরে চিকিৎসক জানান, উচ্চ রক্তচাপ ছাড়া তার তেমন কোনো সমস্যা নেই। দুদকের এক কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, আবদুল হাই বাচ্চু নার্ভাস বোধ করেছেন। তাঁর খারাপ লাগছে জানালে একজন চিকিৎসক ডেকে আনা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিন সোমবার তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নিজেকে তিনি দোষী বলে মনে করেন না।
দুদক সূত্র জানায়, আব্দুল হাই বাচ্চু দুদকের তলবে হাজির হলে সকাল ১০টার দিকে দ্বিতীয় দিনের মত জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। কমিশনের পরিচালক একেএম জায়েদ হোসেন খান ও সৈয়দ ইকবালের নেতৃত্বে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
জিজ্ঞাবাসাদ শেষে দুদকের নতুন ভবনের তৃতীয় তলা থেকে নেমে এলে বাচ্চুকে ঘিরে ধরে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন সাংবাদিকরা। এক পর্যায়ে তিনি ভিড় ঠেলে মূল ফটক দিয়ে বেরিয়ে যান। তখনও কয়েকজন সাংবাদিককে বাচ্চুর পেছনে ছুটতে দেখা যায়। বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান তখন মোবাইল ফোনে গাড়ি চালককে তাগাদা দিচ্ছিলেন। কয়েকজন সাংবাদিক এ সময় বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি এবং দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে প্রশ্ন করেন বাচ্চুকে। তবে কোনো উত্তর তারা পাননি। গাড়ির অপেক্ষায় মোবাইল চাপতে চাপতে বাচ্চুকে বলতে শোনা যায়, “কী বিপদেই না পড়লাম!”
দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে দুপুরে খাবারের প্রস্তাব দিলে বাচ্চু শুধু চা-বিস্কুট খান। দুপুরে কিছুটা অসুস্থ বোধ করলে দুদকের মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক জ্যোতির্ময় চৌধুরী তাকে পরীক্ষা করে দেখেন। পরে চিকিৎসক জানান, উচ্চ রক্তচাপ ছাড়া তার তেমন কোনো সমস্যা নেই।
কমিশনের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, আব্দুল হাই বাচ্চুকে ৫৬টি মামলার মধ্যে ১৫টি মামলার বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুই তদন্ত কর্মকর্তা। অন্য মামলায় আবারও তাকে জিজ্ঞাসাদ করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রনব।
বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কয়েক দফা পর্যবেক্ষণ আসার পর সম্প্রতি ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেয় দুদক। বাচ্চুর আগে ব্যাংকের সাবেক ১০ পরিচালককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরা হলেন- ব্যাংকটির পরিচালনা পর্যদের সাবেক সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম, আনিস আহমদ, কামরুন নাহার আহমেদ, অধ্যাপক কাজী আকতার হোসাইন, সাখাওয়াত হোসেন, ফখরুল ইসলাম, একেএম কামরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, শ্যাম সুন্দর শিকদার ও একেএম রেজাউর রহমান।
২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়াত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণের অভিযোগ ওঠার পর তদন্তে নামে দুদক।
ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া, জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দানসহ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বিধি বহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে। প্রায় চার বছর অনুসন্ধান শেষে এই অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় গত বছর রাজাধানীর তিনটি থানায় ১৫৬ জনকে আসামী করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। আসামীদের মধ্যে ২৬ জন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বাকিরা ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক জরিপ প্রতিষ্ঠানে যুক্ত।
তবে আসামীর তালিকায় বাচ্চু বা ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের কেউ না থাকায় দুদকের ওই তদন্ত নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এ বিষয়ে দুদকের বক্তব্য ছিল, ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা তারা পায়নি। তাই তার নাম আসামীর তালিকায় রাখা হয়নি।
কিন্তু গতবছর ফেব্রুয়ারিতে সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ করা নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে অনিয়মিত ঋণ মঞ্জুর, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল।
আর চলতি বছর অগাস্টে এক মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদকে আসামী না করায় উষ্মা প্রকাশ করে। ব্যক্তি যেই হোক না কেন- এ ধরনের মামলায় আসামী করার ক্ষেত্রে ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ যেন না হয় সে বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সে সময় সতর্ক করে আদালত।
এ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে দুদকের একজন পরিচালক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আসামীর তালিকায় নাম না থাকলেও তদন্তের প্রয়োজনে বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য বাচ্চুকে ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়নও হয়।
কিন্তু ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করার পর চাপের মুখে থাকা বাচ্চু পদত্যাগ করেন।
দুদক জানায়, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে গতকালের মতো জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। আবারও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এর আগে গত সোমবার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের বেসিক ব্যাংকের কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে দুদককে যতটুকু বলা সম্ভব ছিল, সব বলেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও তাঁর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদকে জিজ্ঞাসাবাদে সম্প্রতি নোটিশ দেয় দুদক। অনুসন্ধান শুরু হওয়ার প্রায় চার বছর পর দুদক প্রথমবারের মতো তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিশ দেয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের কয়েক দফা পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। আবদুল হাই বাচ্চুসহ পর্ষদের ১১ জনকে পর্যায়ক্রমে তলব করা হয়। গত ৪ ডিসেম্বর জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত থাকার জন্য গত ১৮ নভেম্বর আবদুল হাই বাচ্চুর বনানীর ডিওএইচএসের বাড়ির ঠিকানায় নোটিশ পাঠানো হয়। পর্ষদের অন্য সদস্যদেরও ডাকা হয় বিভিন্ন দিনে।
আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন পর্ষদ ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে ৩ হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ঋণের নামে বিভিন্নজনকে দিয়ে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন তদন্ত করে বলেছিল, ‘৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না। এই ঋণ আদায়ের সম্ভাবনাও কম।’
০৭ ডিসেম্বর ২০১৭,বৃহস্পতিবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/ সংগ্রাম/আসাবি