জাফর ইকবাল : সংলাপ-সমঝোতা নয়, সংঘাতের পথেই হাঁটছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী জোটসহ দেশী-বিদেশী বিশিষ্টজনদের আহ্বানকে চরম উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ দলের সিনিয়র নেতাদের মন্তব্যে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সরকারি দলের মনোভাবকে ‘অশনি সংকেত’ হিসেবেই দেখছেন। বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে হুশিয়ারি দেয়া হয়েছে এই বলে যে, সরকার যদি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি না মানে তাহলে আন্দোলন ছাড়া আর কোন উপায় নেই। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের একগুয়েমী মনোভাবের কারণে এতে ঘনীভূত হচ্ছে সংকট, যেটা দেশের জন্য ক্ষতি ডেকে আনবে। আর সেখান থেকে উত্তরণও কঠিন হবে।
সূত্র মতে, একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছি। তারা বারবার বলছে, শেখ হাসিনার অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। সর্বশেষ গত ১১ নবেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে দলটির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবে বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, হতে পারে না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। যেখানে জনগণ নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। সরকারের প্রতি সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি কোনো সংঘাতে যেতে চায় না। সুষ্ঠু রাজনীতি করার মাধ্যমে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়। এজন্য সকল দলকে নিয়ে বিএনপি জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলবে। খালেদা জিয়া বলেন, মানুষ পরিবর্তন চায়। আমরা আগেই বলেছি, পরিবর্তন হতে হবে নির্বাচনে। পরিবর্তন হতে হবে ভোটের মাধ্যমে। একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন হতে হবে। মানুষকে ভোট দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে দেশের মানুষ কী চায় সেইটা যাচাই করুন।
অন্যদিকে গত ৬ ডিসেম্বর গণভবনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসবে। এবার আর তারা ভুল করবে না। আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, এমন কোনো দৈন্যদশা সরকারের হয়নি যে আগাম নির্বাচন দিতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণতান্ত্রিক একটি দেশে যে দলগুলো গণতন্ত্র চর্চা করে, সেসব দলের নির্বাচনে আসা কর্তব্য। তবে কে নির্বাচনে আসবে আর কে নির্বাচনে আসবে না, সে ব্যাপারে সরকারের কিছু করণীয় নেই। বিএনপিকে নির্বাচনে আনা নিয়ে সরকারের করণীয় বিষয়ে বারবার প্রশ্ন না করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘বিএনপিকে নির্বাচনে আনা নিয়ে যদি আপনাদের এতই আগ্রহ থাকে, তাহলে তেলের টিন, ঘিয়ের টিন নিয়ে সেখানে যান। আমি অপাত্রে ঘি ঢালি না।’ আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে কি না? উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বরণডালা পাঠাতে হবে?
জানা গেছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে আন্দোলনের পথেই যেতে হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। একইসাথে এই দাবিতে অনঢ় থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এই আন্দোলনে যোগ দেবে। এরই মধ্যে জোটের বাইরে থাকা অন্য দলগুলোর সাথে আন্দোলনের বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে। গত ১২ নবেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়াদী উদ্যানের মহাসমাবেশে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও জোটের শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, সবাইকে নিয়েই তিনি কাজ করছেন। একইসাথে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
জানা গেছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ইস্যুতে ন্যূনতম ছাড় দিতে রাজি নয় ২০ দল। তারা বলছে, সরকার যদি তাদের একগুয়েমী পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে চলমান সংকটের সমাধান না করে তাহলে আন্দোলনই তার সমাধান ঘটানো হবে। এজন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিচ্ছে জোট। তারই অংশ হিসেবে জোটের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন বেগম জিয়া। সেখানে নির্বাচন ইস্যুই ছিল প্রধান আলোচনার বিষয়। জোটের শীর্ষ নেতারাও বলেছেন, সরকারকে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও যদি নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের বহি:প্রকাশ না ঘটে, তাহলে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
আন্দোলনের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, এবার আওয়ামী আর একতরফা নির্বাচন করতে পারবেনা। তাদেরকে সহায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে। তিনি বলেন, তারা সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু এই সংবিধানতো তারাই সকলের মতামতকে তোয়াক্কা না করে সংশোধন করেছে। সংবিধানতো জনগণের জন্যই। এটি সংশোধন করেই নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্যথায় বিরোধী জোট ঘরে বসে থাকবেনা। রাজপথের আন্দোলনেই এবারের সংকটের সমাধান করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার বিএনপিকে নিয়ে যেসব কথা বার্তা বলছে সেটি তারা ভয়ে বলছে। কারণ তারা জানে, নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে। তাই তারা যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় থাকতে চায়। এবার দেশের জনগণ সেটি হতে দিবেনা।
জানা গেছে, নতুন বছরের শুরু থেকেই ‘সক্রিয়’ আন্দোলনে মাঠে নামবে ২০ দলীয় জোট। তার আগে চলতি বছরের বাকি দেড় মাস দল গোছানো এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, গুম-খুনসহ সরকারের নানা অনিয়ম তুলে ধরে জনমত গড়ে তোলার কাজ করবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এই ইস্যুতে দল ও জোটের বাইরে থাকা অন্যান্য সংগঠন ও পেশাজীবি সংগঠনগুলোর সাথে আলোচনা করবেন বেগম জিয়া। তারই অংশ হিসেবে আজ শনিবার দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ ও যুগ্ম সম্পাদকদের নিয়ে বৈঠক করবেন তিনি। ফলে আপাতত সভা-সমাবেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে দলটির কার্যক্রম। সূত্রের দাবি, এখনই সক্রিয় আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই বিএনপির। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার সমঝোতার পথে না আসলে নতুন বছরের শুরুতেই ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে তোলার ছক কষছে দলটি।
আন্দোলনের বিষয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসভাপতি মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ (বীর বিক্রম) বলেন, বিএনপি ভোটের জন্য প্রস্তুত, একইসাথে আন্দোলনের জন্যও প্রস্তুত। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায়, জনগণের সেবা করার দায়িত্ব পেতে চায়। কিন্তু এই সরকারের আমলে একটি নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবে হয়নি। খোদ ঢাকা শহরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাজধানীবাসী ভোট দিতে পারেননি। বিএনপির প্রার্থীর কোনো এজেন্ট ছিল না, বেগম জিয়ার গাড়িবহরে তিনবার আক্রমণ করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে বিশ্বাস করা যায় না। তবু আমরা আশা করব আওয়ামী লীগ সরকারের চৈতন্যোদয় হবে।
বিএনপির কোনো দাবি মানা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। শনিবার মহানগর নাট্যমঞ্চে বাংলাদেশ দলিল লেখক সমিতির ‘কেন্দ্রীয় কাউন্সিল’২০১৭ এর প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। আনিসুল হক বলেন, সংবিধানের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই নির্বাচন হবে। বিএনপি যদি নির্বাচনে আসতে চায় তাহলে বাংলাদেশের আইন মেনে নির্বাচনে আসতে হবে। তাদের জন্য কোনো নতুন আইন করে তাদেরকে নির্বাচনে আনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মারা গেছে, তার কবর রচনা হয়েছে। এটা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। আওয়ামী লীগ আন্দোলনের চ্যাম্পিয়ন। আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, আন্দোলন কীভাবে করতে হয় আওয়ামী লীগ জানে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের একগুয়েমী আচরণের কারণে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে বেশ কিছুদিন শান্ত থাকা রাজপথ আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। তারা বলছেন, বিরোধী জোটসহ দেশে বিদেশে সবাই নির্বাচন ইস্যুতে একটি বাস্তব সম্মত উপায় বের করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের অনিহা, বারবার সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখান, সমঝোতা না করাসহ নির্বাচন কমিশনের সরকার প্রীতির কারণে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের সামনে আন্দোলন অনিবার্য হয়ে উঠছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের আন্দোলনে তারা আগের ভুলগুলো করবেন না। অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো তাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তুলবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাসীন আ’লীগ যে চলমান রাজনৈতিক সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান চায়না সেটি দলটির সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যেই ফুটে উঠেছে। একইসাথে তারা স্বরণ করে দিয়ে বলেন, দেশের প্রায় সব ক’টি রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এবার সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনকালীন সহায়ক দেশবাসী দেখতে চায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার যদি সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরীতে সরকার ব্যর্থ হয় তাহলে আগামী নির্বাচন ঘিরে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট আরো বাড়বে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি কাজ করছে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মাঝে মাঝে আশার আলো দেখা গেলেও তা খুবই ক্ষীণ। নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার না চাইলে নির্বাচন কমিশন কিছুই করতে পারবে না। বাংলাদেশে সে ধরনের নির্বাচন কমিশন গঠন হয়নি। যেভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন হয় এবং কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাতে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ রাজনীতি নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে শুধু নির্বাচন ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে যে ধরনের শাসন ব্যবস্থা বিরাজমান তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার ব্যাপার রয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে আবারও অশনি সংকেত দেখি। বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই পক্ষই খুব ভালো করে বলছে- তারা (বিএনপি) নির্বাচনে আসবে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া জোর দিয়ে বলছেন তিনি শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। উনি যদি নির্বাচন বয়কট করেন তাহলে আগামীতে নির্বাচন হবে বলে মনে হচ্ছে না। একটা মুখোমুখি অবস্থা তৈরি হচ্ছে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্নে দেশের সকল জনগণ ঐক্যবদ্ধ। নির্বাচন নিয়ে ছলচাতুরী-টালবাহানা জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ১৩ ডিসেম্বর,২০১৭ বুধবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/ সংগ্রাম/আসাবি
Check Also
তালায় ইউপি পরিষদ কক্ষে দুই সাংবাদিকের উপর হামলা, প্রতিবাদে মানববন্ধন
তালা প্রতিনিধি তালার ইসলামকাটি ইউনিয়ন পরিষদে সাংবাদিক আক্তারুল ইসলাম ও আতাউর রহমানের ওপর সন্ত্রাসী রমজান আলী …