জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে সতক্ষীরা সহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ নদী এখন মরা খাল: টিআরএম বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন
# নদী না বাঁচলে সাতক্ষীরা ৫লক্ষ মানুষ বাঁচা দায়
# ইতিহাস থেকে বিদায় নিয়েছে খুলনা বিভাগের বড় পাঁচ নদী
আবু সাইদ বিশ্বাসঃসাতক্ষীরা : জলবায়ু পরিবর্তন,উজান থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহ বন্ধ,অবৈধ দখল সহ নদীতে বাঁধ নির্মাণের কারণে সাতক্ষীরা সহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। সাতক্ষীরার মরিচাপ নদী বিদায় নিয়ে ইতিহাস হয়ে দাড়িয়েছে।কপতাক্ষ নদ তার প্রবাহ হারিয়ে ফেলেছে। তালার শালতা নদী হারিয়ে যাওয়ার পথে।
হারিয়ে যাওয়া নদী পুর্ণউদ্ধার সহ শালতা নদী খনন ও টিআরএম বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী। বুধবার দুপুরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে পানি কমিটির ব্যানারে শালতা অববাহিকার শত শত মানুষের উপস্থিতিতে এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। দাবী একটায় নদী বাঁচাও মানুষ বাঁচাও।
এছাড়া খুলনা বিভাগের পাঁচটি নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। মরে গেছে আরো চারটি নদী। এছাড়া প্রায় অর্ধশত নদীতে বালু জমে বড় বড় চর পড়েছে। পাশাপাশি শুষ্ক মওসুমে নদীতে পানির পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় সংযোগ খালগুলোতে একেবারেই পানি নেই। সেচ ব্যবস্থা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। খুলনা বিভাগ থেকে যে পাঁচটি নদী ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে তা’ হলোÑ খুলনার হামকুড়া, সাতক্ষীরার মরিচাপ, কুষ্টিয়ার হিসনা এবং যশোরের মুক্তেশ্বরী ও হরিহর নদী।
নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রধান নদ-নদীগুলো প্রতি বছর চ্যানেল পরিবর্তন করছে। এতে একদিকে যেমন ভাঙ্গন সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে পলির স্তর জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শাখা উপশাখা। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র পানি সংকট।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের জরিপ মতে-শুষ্ক মওসুমে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের ১৯টি নদীর পানি শুকিয়ে যায়। বর্ষা মওসুমের আগ পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।
নদী ও পরিবেশ গবেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের জীবন নদীতেই বাধা। নদীকে ঘিরেই বাংলাদেশ। আমাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কাব্য-সাহিত্য, জীবন-জীবিকা সব কিছুই নদীকে নিয়ে। শুষ্ক মওসুম এলে চিরচেনা নদীগুলোর দিকে তাকানো যায় না। নদীগুলোর শুকনো, চরপড়া বুকের দিকে তাকালে হাহাকার ধ্বনিত হয় হৃদয়ে। যে সব নদী ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে, তার বুকে।
নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীগুলোর সাথে তাদের প্রাণভোমরা মূল নদীর সংযোগ ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড নদীকে গলাটিপে মারছে। নদী মরে যাওয়ার কারণে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন যাত্রা। দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। চলতি শুষ্ক মওসুমে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে। শুষ্ক মওসুমেই যেন নদীর মড়ক লাগে। আর এই মরা নদীর সাথে হারিয়ে যাচ্ছে এক একটি ইতিহাস।
কপোতাক্ষ পাড়ের ৫ লক্ষাধিক মানুষের জীবন হুমকির মুখে: ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতার বিস্তৃতি, তীব্রর্তা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি, সিডর-আইলার মতো জলোচ্ছ্বাসের কারণে সাতক্ষীরার কপোতাক্ষ পাড়ের ৫ লক্ষাধিক মানুষের জীবনের বিপর্যয় নেমে এসেছে। ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এ অঞ্চলের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। জীবন-জীবিকার পথ রুদ্ধ করে পথে বসেছে হাজার হাজার মানুষ। অন্যদিকে খনন কাজে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ায় নদী খননে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
কপোতাক্ষ অববাহিকার ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের ভাগ্য জড়িত। চলতি বছর যদি শালতা নদী খনন ও টিআরএম বাস্তবায়ন প্রকল্প শুরু না হয় তবে কপোতাক্ষ নদের অকাল মৃত্যু অনিবার্য। এতে জনপদের ধ্বংস ডেকে আনার পাশাপাশি এ নদের সাথে যুক্ত নিচের অন্যান্য নদীসমূহ দ্রুত বিপর্যয়ের কবলে পড়বে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, কপোতাক্ষ নদের সমাধানকল্পে একাধিকবার নদী খনন করা হয়েছে কিন্তু তাতে ফলপ্রসূ কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। নদীটি পলিজমে দ্রুত ভরাট হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে টিআরএম’কে ভিত্তি করে প্রকল্প প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। উত্তরণ, পানি কমিটি, কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনসহ বিভিন্ন মহল থেকে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে টিআরএম বাস্তবায়নের জোরালো দাবি উত্থাপন করা হয়।
বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১০-১১ অর্থবছরে কপোতাক্ষ নদ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু প্রকল্প প্রণয়নে বিলম্ব এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ার ধীর গতির কারণে ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। ৪ বছর মেয়াদী প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এদিকে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে এমনিতেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল বিশ্বের মধ্যে সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে বিবেচিত হচ্ছে। আশংকা করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে এ অঞ্চল সমুদ্র গর্ভে বিলীন হবে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য টিআরএম একটি কার্যকরী পদ্ধতি। এ পদ্ধতির প্রয়োগ ছাড়া জোয়ার-ভাটার নদীগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলে পানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
শালতা নদী খনন ও টিআরএম বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শালতা নদী খনন ও টিআরএম বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী। বুধবার দুপুরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে পানি কমিটির ব্যানারে শালতা অববাহিকার শত শত মানুষের উপস্থিতিতে এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।
মানববন্ধন কর্মসূচি চলাকালে বক্তব্য রাখেন, সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, শালতা বাঁচাও কমিটির সভাপতি সরদার ইমান আলী, কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি এবিএম শফিকুল ইসলাম, সহ অনেকে।
বক্তারা বলেন, তালা উপজেলার জীব বৈচিত্র্য রক্ষা, জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ সমস্যা মোকাবেলায় শালতা নদী খনন করে টিআরএম বাস্তবায়ন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। অন্যথায় শালতা অববাহিকার মানুষ বাঁচতে পারবে না।
বক্তারা এ সময় শালতা নদীর সাথে আমতলী, বাদুরগাছা, ঘ্যাংরাইল, শিতলাখালী, হাড়িয়া ও নাসিরপুর খালের সাথে সরাসরি সংযোগ দিয়ে এর অববাহিকায় টিআরএম বাস্তবায়ন এবং নদী দখল বন্ধ করার দাবি জানান। পরে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মোঃ মহিউদ্দীনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়।
২৭ ডিসেম্বর,২০১৭ বুধবার:ক্রাইমর্বাতা.কম/প্রতিনিধি/আসাবি