ধর্মীয় সহিষ্ণুতা : নৈতিকতা ও ধর্মীয় মর্যাদা

॥ আব্দুর রাজ্জাক রানা ॥
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এমন বিষয়, বর্তমান সময়ে যার গুরুত্ব অপরিসীম। পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, মানবিক সহমর্মিতা ও ইসলামী শিক্ষার আলোকে উন্নত নৈতিকতা ও ধর্মীয় মর্যাদার বিস্তার ঘটানো বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা।
আজকের পৃথিবী উন্নতি-অগ্রগতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগত। মানুষ দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে উন্নতি সাধন করছে। অপরদিকে আরো দ্রুত গতিতে মানুষ শঙ্কা ও ভয়, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য, অত্যাচার, নিপীড়ন ও ত্রাসের জাহান্নামী গর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। যদি বলা হয় যে, আজকের উন্নত দুনিয়ার নিরাপত্তার ওপর নিরাপত্তাহীনতা ও সর্ব প্রকার পক্ষপাতিত্বের হামলা এমন একটা প্রশ্ন, যা মানবতার সাথে উপহাস করে চলছে, তাহলে অনর্থক হবে না।
মানবসমাজে অশ্লীলতা ও নিরাপত্তাহীনতার বীজ নিজে নিজেই উৎপন্ন হয়নি। বরং তা কিছু মানুষের ভুলের কারণে অস্তিত্ব লাভ করেছে। তারপর দুর্বৃত্তদের অপকর্ম ও ক্রমাগত বিশৃঙ্খলার ফলে তা বৃদ্ধি পেয়ে পূর্ণ গাছে পরিণত হয়েছে। যার শিকড় মানবসমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ¯্রষ্টা প্রদত্ত কানুন ও প্রকৃতির নীতি হলো, ‘যেমন বীজ বুনবে, তেমন ফল কাঁটবে।’
তবে এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশ্ব মানবের স্বস্তি ও শান্তি লাভ হয়েছে সেই ক্ষেত্রে, যখন মানুষ আল্লাহর নির্দেশিত রাস্তায় চলেছে। এটা এমন কোনো দর্শন বা যুক্তি নয় যা, বোঝা যায় না। বরং পরীক্ষা ও চাক্ষুষ দর্শন এ বিষয়ে সব চেয়ে বড় প্রমাণ। আসমানী হেদায়েত ও আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষা ব্যতীত আর এমন কিছু নেই, যা মানুষকে সঠিক গন্তব্যের পথ দেখাবে। আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষায় অবিচল থাকাতেই মানবতার শান্তি ও নিরাপত্তা আসবে নতুবা নয়। এজন্য আজকের উন্নত যুগেও বিশ্ব মানবতার শান্তি ও নিরাপত্তার সৌধ ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে ওই চিরন্তন, প্রত্যাদির্ষ্ট, সার্বজনীন অধিকার, কর্তব্য এবং দাওয়াত ও দাবির ভিত্তির ওপর নির্মাণের মাঝে নিহিত, যা আল্লাহ প্রদত্ত প্রধান প্রধান ধর্ম প্রচার করেছে।
আলহামদু লিল্লাহ! আমরা সবাই মুসলমান। এক আল্লাহ, এক নবী এবং এক কিতাবের অনুসারী। হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম পর্যন্ত সব নবী ও সমস্ত আসমানী কিতাবের প্রতি আমরা ঈমান রাখি। আল্লাহর তাওহিদে, কুরআন পাক এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের প্রতি ঈমান রাখা আমাদের আকিদার মূল দাবি।
ইসলামে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতি বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সূরা ইউনুসে বলেন-‘আপনার প্রভু যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে পৃথিবীর সব মানুষ অবশ্যই ঈমান আনতো। তবে কী আপনি মানুষদের চাপ প্রয়োগ করবেন যে, তারা মুমিন হয়ে যাক?’ (আয়াত নং -৯৯) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম অনেক সুন্দর মতামত পেশ করেছেন। কাউকে চাপ দিয়ে নিজের আকিদা-বিশ্বাস তার ওপর চাপিয়ে দেয়া ইসলামে অপছন্দনীয় ও নিষিদ্ধ। কুরআনের শিক্ষা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের পবিত্র জীবনী মূলত ও কার্যত সাব্যস্ত করেছে যে, কারো ওপর কোনো দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মগ্রহণ করা না করার ব্যাপারে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা সব নবীকে মানুষের কাছে শুধু আল্লাহর বাণী ও পয়গাম পৌঁছানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদের আকিদা ও ঈমান গ্রহণের ব্যাপারে বল ও চাপ প্রয়োগের অবকাশ দেননি। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে ইসলাম প্রচারক ও আলিমগণের জন্য দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ম ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়েছেন। যদি ইসলামী বিশ্ব কুরআন পাকের সহিষ্ণুতার পয়গাম এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুণ্যময় জীবনাদর্শের আলোকে নূরানী পথে সঠিকভাবে চলতো, তাহলে আমরা অবশ্যই অন্যান্য জাতিকে চিন্তা, দর্শন, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ময়দানে নেতৃত্ব ও পরিচালনার দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারতাম।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বদৌলতেই পাক ভারত উপমহাদেশে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। এ ভূখ-ে ইসলাম তরবারির জোরে আসেনি, বরং সুফিয়ায়ে কেরাম এবং আওলিয়া কেরামের সহিষ্ণুতার ওপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা এবং সাধারণ মানুষের সাথে সম্প্রীতি ও সহানুভূতি মূলক আচরণের বদৌলতে বিস্তার ঘটেছে। উপমহাদেশে ইসলাম আগমনের সময় এখানে ধর্মীয় বিবাদের সরগরম পরিবেশ ছিল। হিন্দুত্ববাদ অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের মাঝে চূড়ান্ত লড়াই চলছিল। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তারা অকাতরে মানুষ খুন করত। এ অবস্থায় ইসলামের সহিষ্ণুতার ওপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা এবং মুসলিম সুফিয়ায়ে কেরামের আবেগপূর্ণ সহানুভূতির বাণী ইসলাম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। এটা বাস্তব যে, দুনিয়ার যেখানেই ইসলাম প্রসার লাভ করেছে, স্বীয় সহিষ্ণুতা এবং মানবিক সুউঁচ্চ গুণাবলীর ফলেই লাভ করেছে।
আজ প্রয়োজন ইসলামের উৎস কুরআন মাজিদ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের আলোকরশ্মি অর্জন করে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক সংহতি ও ঐক্যের পয়গাম ব্যাপক করার সম্ভাব্য সব চেষ্টা করা।
আমাদেরকে ইসলামের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ওপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা বিস্তার করার প্রতি একান্ত মনোযোগী হতে হবে। কেননা, এটা এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। সাথে সাথে সব বড় বড় ধর্মের বিজ্ঞপন্ডিত এবং বিশেষজ্ঞগণকে আজকের বস্তুবাদী দুনিয়ার প্রবণতা রোধ করার জন্য সামাজিক পর্যায়ে এমন একটা সংস্থা গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগী হতে হবে, যার মাধ্যমে বাস্তবিক অর্থে বর্তমান দুনিয়ার জন্য সাম্য, ন্যায় ও নিষ্ঠা, অর্থনৈতিক সুব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা ও শান্তির নেয়ামত অর্জন হতে পারে। বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার সমাপ্তি ঘটবে, ব্যক্তিগত শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বস্তি এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা অর্জিত হবে। এমনিভাবে জনগণের মধ্যে আন্তরিক ও বুদ্ধিভিত্তিক চেতনার সঞ্চারণ হবে। মানব মর্যাদার শ্লোগান উঠবে।
দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ এই সময়ে পৃথিবী থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা ছিনিয়ে নিয়েছে। আরো বড় পরিহাস এই যে, ইসলামকে ত্রাস সৃষ্টিকারী ও ধর্মান্ধতা বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। পৃথিবীর যেখানেই কোনো দুর্ঘটনা বা নাশকতা ঘটে, সেখানে সেটাকে ইসলাম ও মুসলিমদের ওপর চাপানো হয়। অথচ বাস্তবতা এই যে, প্রকৃত অর্থে ইসলাম বিশ্ব নিরাপত্তার ব্যাপারে ‘সর্বাত্মক’ সজাগ দৃষ্টি রাখে। অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে আচরণই এ ব্যাপারে বাস্তব সাক্ষী ও প্রমাণিত সত্য। নবী করীম (সা.)-এর শেষ খুতবা বিশ্ব মানবতার মর্যাদার সার্বজনীন ঘোষণা, মদিনা মুনাওয়ারায় সম্পাদিত চুক্তি মদিনার সনদ এবং নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথেকৃত চুক্তিই বাস্তব প্রমাণ যে, বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের মানবতার কল্যাণের জন্য পরস্পর মিলেমিশে কাজ করা উচিত। যদি সবাই সম্মিলিতভাবে কল্যাণের পথে চলে, তাহলে হিত-মঙ্গল ও সুখ-সমৃদ্ধি অর্জন হওয়া নিশ্চিত। এতেই মানবতা উন্নত হবে। সকল ধর্মের দাবি ও আবেদন যেহেতু কল্যাণ ও মঙ্গলের বিস্তার ঘটানো, সুতরাং সে ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকা অনুচিৎ যা শান্তি, নিরাপত্তা, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতি এবং কল্যাণ ও সফলতার পরিপন্থী হয়। সম্প্রীতি ও সহানুভূতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারে ইসলামী শিক্ষা অর্জন করা এবং তা প্রচার করা সময়ের একানÍ দাবি। যে জাতি সময়ের চাহিদার প্রতি মনোযোগ দেয় না, তাদের গলায় দাসত্বের শিকল পেঁচিয়ে যায় এবং এই শিকল তাদের গোলামী জীবনযাপন করতে বাধ্য করে। আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে ওই শিকল নিজেদের গলা থেকে খোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। মুসলিম জাতির কল্যাণের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফরমান, ‘ইসলামেই উৎকৃষ্ট, তার চেয়ে উৎকৃষ্ট (আর কোনো ধর্ম, দ্বীন, দর্শন) নেই’-এর ফল প্রকাশ করতে হবে।
এটা জ্ঞান ও বিবেকের দাবি। আমাদের সর্ব প্রকার মতানৈক্য ভুলে গিয়ে মুসলিম জাতির শান্তি, প্রগতি এবং নিরাপত্তার প্রতি একান্ত মনোযোগ দিতে হবে। এমন একটা মুসলিম সমাজ গড়তে হবে, যা ইসলামের আলো এবং সহিষ্ণুতাপূর্ণ শিক্ষার বহিপ্রকাশ ঘটাবে, যা সহিষ্ণুতাকামী হবে, যা মুসলমানদের সরল পথ প্রদর্শন করবে এবং যা বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার নেতৃত্ব দেবে। যার অনুসারীদের মধ্যে অতি পছন্দনীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমাবেশ ঘটবে। যেখানে আতঙ্ক ও সন্ত্রাস সৃষ্টি হবে না। যেখানে হটকারিতা বৈপরিত্য এবং অহমিকা থাকবে না। যেখানে বাস্তবতাকে তার সঠিক দৃষ্টিতে বুঝে ব্যক্তিগত কার্য-তালিকা প্রস্তুতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হবে।#
(লেখক : সাংবাদিক)

Check Also

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ দেবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সচিবালয় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।