ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: বঙ্গোপসাগরের একটি নির্জন ও কর্দমাক্ত দ্বীপকে মিয়ানমারের সামরিক দমন অভিযান থেকে পালিয়ে আসা এক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করছে বাংলাদেশ। সেখানেই উদ্বাস্তুদের শেষ ঠিকানা হবে কিনা তা নিয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে সাঙ্ঘর্ষিক ইঙ্গিতের মধ্যেই এ কাজ চলছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার বলেছেন, কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোর ঠাসাঠাসি অবস্থা হ্রাস করার জন্য ‘সাময়িক ব্যবস্থা’ হিসেবে নিচু দ্বীপটিতে রোহিঙ্গাদের রাখা হবে। গত আগস্টের শেষ থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রায় সাত লাখ উদ্বাস্ত কক্সবাজারের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান করছে।
তবে শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টা রয়টার্সকে বলেছেন, সেখানে যাওয়ার পর তারা চিন্তা করতে পারবে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে নাকি তৃতীয় কোনো দেশে আশ্রয় নেবে।
এইচ টি ইমাম বলেন, এটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প না হলেও সেখানে কিছু বিধিনিষেধ থাকবে। আমরা তাদেরকে বাংলাদেশী পাসপোর্ট বা আইডি কার্ড দেব না। সেখানে ৪০-৫০ জন সশস্ত্র পুলিশের একটি বাহিনী থাকবে।
বর্ষার বৃষ্টিপাতের আগেই উদ্বাস্তুরা যাতে সেখানে যেতে পারে সেজন্য ব্রিটিশ ও চীনা প্রকৌশলীরা দ্বীপটিকে প্রস্তুতির কাজ করছে। এখন যেখানে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প রয়েছে, বর্ষার প্রবল বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় তাদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এপ্রিলের শেষ দিকেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে।
হাসিনার উপদেষ্টা ইমাম বলেন, কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে কাদেরকে ওই দ্বীপে সরিয়ে নেওয়া হবে সে সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে তা লটারি কিংবা স্বেচ্ছাভিত্তিক হতে পারে।
জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক হাই কমিশনার এক বিবৃতিতে বলেছেন, উদ্বাস্তুদের অন্য জায়গা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি স্বেচ্ছায় ও জেনেবুঝে হোক- সে ব্যাপারে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।
দ্রুত ও উদ্দীপ্ত নির্মাণ
উদ্বাস্তুদের ওই দ্বীপে সরিয়ে নেওয়ার প্রথম প্রস্তাবটি করা হয়েছিল ২০১৫ সালে। তখন পরিকল্পনাটির বিরোধিতা করেছিল মানবিক সংস্থাগুলো। তাদের কথা ছিল, পলি জমে সৃষ্টি ওই দ্বীপে প্রায়ই সাইক্লোন আঘাত হানে। তাছাড়া হাজার হাজার লোকের জীবিকার মতোও তা নয়।
তবে প্রকল্পটির কাজ এখন বেশ দ্রুতগতিতে চলছে বলে রয়টার্সের দেখা স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের কাছে পাঠানো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুটি চিঠিতে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এক বছর আগে রয়টার্সের সাংবাদিকেরা যখন ভাসান চর (ভাসমান দ্বীপও বলা যায়) সফর করেছিল, তখন সেখানে কোনো রাস্তা, ভবন বা জনমানুষ ছিল না।
কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারি তারা সেখানে গিয়ে উত্তর-পশ্চিম উপকূলে শত শত লোককে জাহাজ থেকে ইট-বালি বহন করতে দেখেন। স্যাটেলাইট ছবিতে কয়েকটি রাস্তা, একটি হেলিপ্যাডও দেখা গেছে।
মাত্র ২০ বছর আগে দ্বীপটি সাগর থেকে জেগেছে। এটি মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। সমান ও আকার পরিবর্তনশীল এই দ্বীপে জুন-সেপ্টেম্বরে নিয়মিত বন্যা হয়। জলদস্যূরা মুক্তিপণের জন্য প্রায়ই আশপাশের এলাকায় হানা দেয়।
ধাতব ছাদের ইটের ভবনগুলোতে সৌর প্যানেল বসানো হয়েছে। এতে ১,৪৪০টি ব্লক থাকবে, প্রতিটিতে থাকবে ১৬টি করে পরিবার।
চীনা ও ব্রিটিশ কোম্পানি
চীনের থ্রি জর্জেস ড্যাম বানানোর জন্য বেশি পরিচিত চীনা নির্মাণ কোম্পানি সিনোহাইড্রো ২৮০ মিলিয়ন ডলারে ১৩ কিলোমিটার (৮ মাইল) বন্যা প্রতিরোধ বাধ নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।
ব্রিটিশ প্রকৌশল ও পরিবেশ প্রতিষ্ঠান এইচআর ওয়ালিংফোর্ড পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে।
মানবাধিকার গ্রুপ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপপরিচালক ওমর ওয়ারাইচ বলেন, আমরা মানবিক ত্রাণের সাথে জড়িত যাদের সাথে কথা বলেছি, কেউই এটিকে ভালো আইডিয়া বলেনি।
কাছের সন্দ্বীপের লোকজন জানায়, মওসুমি ঝড়ে নিয়মিত লোকজন মারা যায়, বাড়িঘর ধ্বংস হয়, মূল ভূখণ্ডের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সদস্য মহাপরিচালক কবির বিন আনোয়ার বলেন, ত্রাণ সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে না জানার কারণেও এ নিয়ে নেতিবাচক কথা বলছে।
তিনি বলেন, সরকার সেখানে সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করছে। তাছাড়া চরটিতে লবণ-সহিষ্ণু ধান লাগানো যাবে, লোকজন মাছ ধরতে পারবে, গরু-মহিষ চড়াতে পারবে।
চরে মৌলিক পরিষেবা নিয়ে সৃষ্ট সংশয়ও উড়িয়ে দিয়েছেন আনোয়ার।
সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী বেলাল বেগ (৮০) বলেন, ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের বসবাস নিয়ে প্রতিরোধ সৃষ্টির কারণ হলো বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশীই প্রতি বছর উপকূল ক্ষয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, তাদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমাদের উচিত ছিল আগে নিজেদের লোকজনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু সরকার এখন অভিবাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে।
অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকেও দূরের ওই দ্বীপে সরে যাওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলছে।
চাকমকুল উদ্বাস্তু কেন্দ্রের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু জাহিদ হোসাইন বলেন, তিনি জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছেন। এখন ভাসান চলে জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করবেন না।
তিনি বলেন, আমি সেখানে না গিয়ে বরং এখানেই মারা যাব।
দ্বীপটি সম্পর্কে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে হাসিনা বলেন, সহজাত দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা যায়, এটি বেশ সুন্দর জায়গা। প্রাথমিক পরিকল্পনা হলো সেখানে এক লাখ লোককে আশ্রয় দেওয়া। এখানে ১০ লাখ লোকের আশ্রয় সম্ভব।southasianmonitor