ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: পূর্ব-পশ্চিম বা পশ্চিম-পূর্ব যাতায়াতে নেপালিরা সাধারণত ‘চোখো দিন’ (পবিত্র দিন) হিসেবে বেছে নেয় সোমবারকে। গত সপ্তাহের সেই সোমবারে ৩৩ নেপালি, এক চীনা আর মালদ্বীপের এক নাগরিকের সঙ্গে উচ্ছ্বাস নিয়ে ঢাকার মাটি ছেড়ে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজে উড়াল দিয়েছিল ৩৬ বাংলাদেশি। এর এক সপ্তাহ পর আজ সেই সোমবারেই একসঙ্গে ২৩ বাংলাদেশি আবার ফিরছে ঢাকার মাটিতে, অথচ প্রাণহীন-নিথর।
ওই বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ৪৯ আরোহীর মধ্যে বাংলাদেশি ২৬ জন। এর মধ্যে গতকাল রবিবার পর্যন্ত ২৩ বাংলাদেশির মরদেহ শনাক্ত করা হয়েছে। কাঠমাণ্ডুর বসুন্ধরা এলাকায় বাংলাদেশ দূতাবাস প্রাঙ্গণে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী আজ জানাজা বা প্রার্থনা শেষে এসব মরদেহ ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে ঢাকায় পাঠানো হবে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমান এসব মরদেহ নিতে আসবে।
এর আগে দুর্ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় গত শনিবার দিনভর ২৫ জনের মরদেহ শনাক্ত করেন বাংলাদেশ-নেপালের যৌথ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে ১৪ জন ছিল বাংলাদেশের। পরে ওই দিন সন্ধ্যায় আরো তিনজন বাংলাদেশি এবং গভীর রাতে আরো চার নেপালির মরদেহ শনাক্ত করা হয়। গতকাল আরো ছয় বাংলাদেশি এবং আরো আট নেপালির মরদেহ শনাক্ত করা গেছে। সে হিসাবে গতকাল রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহত ৪৯ জনের মধ্যে মোট ৪৬ জনের মরদেহ শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্ত হওয়ার বাকি তিন মরদেহই বাংলাদেশির। এরই মধ্যে চীনের একজন ও নেপালের নিহত ২২ জনেরই মরদেহ শনাক্ত করা হয়েছে।
ঢাকা থেকে আসা বাংলাদেশ মেডিক্যাল টিমের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডা. সোহেল মাহমুদ এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বাকি যাদের মরদেহ এখনো শনাক্ত করা যায়নি তাদের শনাক্ত করতে ডিএনএ টেস্টের আশ্রয় নিতে হবে। আর ওই টেস্ট শেষ করে স্বজনদের ওই মরদেহগুলো পেতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে।
গত শনিবার যে ১৭ বাংলাদেশির মরদেহ শনাক্ত করা হয়েছিল তাঁরা হলেন বিলকিস আরা, রকিবুল হাসান, হাসান ইমাম, মিনহাজ ইবনে নাসির, মতিউর রহমান, তাহিরা তানভিন শশী রেজা, অনিরুদ্ধ জামান, রফিকুজ্জামান, মাহমুদুর রহমান, তামাররা প্রিয়ন্ময়ী, আকতারা বেগম, সানজিদা হক, নুরুজ্জামান, ফয়সাল আহম্মেদ, পাইলট আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশীদ ও ক্রু খাজা হোসেন।
আর গতকাল শনাক্ত হওয়া ছয় বাংলাদেশি হলেন বেগম হারুন নাহার বিলকিস বানু, নাজিয়া আফরিন, আঁখি মনি, এফ এইচ প্রিয়ক, উম্মে সালমা ও শারমিন আক্তার। এখন শুধু আলিফুজ্জামান, নজরুল ইসলাম ও পিয়াস রায়—এই তিন বাংলাদেশির মরদেহ শনাক্ত বাকি রয়েছে।
নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসফি বিনতে শামস গত রাত পৌনে ৮টায় সংবাদ ব্রিফিং করে জানান, শনাক্ত হওয়া বাংলাদেশিদের মরদেহের আজ সকাল ৮টায় জানাজা হবে। এরপর মরদেহ বিমানবন্দরে নেওয়া হবে ৯টার দিকে। সেখান থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিশেষ ফ্লাইটে সেগুলো দেশে নিয়ে যাওয়া হবে।
বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমান কাঠমাণ্ডু থেকে মরদেহগুলো নিয়ে আজ বিকেলে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নেপাল থেকে আসা মরদেহগুলো আর্মি স্টেডিয়ামে নেওয়া হবে। সেখানে জানাজা হওয়ার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এদিকে আগের দিনের মতোই গতকাল সকাল থেকে কাঠমাণ্ডু মেডিক্যাল কলেজের মর্গ এলাকায় আসেন নিহতদের স্বজন ও গণমাধ্যমকর্মীরা। মর্গের ভেতর থেকে শনাক্ত করার কাজে জড়িত কেউ বেরিয়ে এলেই তাঁরা প্রায় একযোগে জানতে চান আর কোনো মরদেহ শনাক্ত করা গেছে কি না।
এদিকে বিকেল ৫টার পর আগের দিন শনাক্ত হওয়া ১৭ বাংলাদেশির মরদেহ মুসলিম রীতি অনুসারে একজন পুরুষ এবং একজন নারীর মাধ্যমে গোসল করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
‘বুকটা ফেটে যাচ্ছে’ : যাদের মরদেহ শনাক্ত হয়েছে তাদের স্বজনরা শোকের মধ্যেও একধরনের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। এখন শুধু তাদের অপেক্ষা মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরার। তবে তাদের পাশেই অনিশ্চয়তা নিয়ে বসে ছিল যাদের মরদেহ এখনো শনাক্ত করা যায়নি তাদের স্বজনরা।
পরিকল্পনা কমিশনের দুই কর্মকর্তা নাজিয়া আফরিন চৌধুরী ও উম্মে সালমা অফিশিয়াল কাজে নেপালে আসার পথে ওই দুর্ঘটনায় মারা যান। নাজিয়ার মরদেহ শনাক্ত হওয়ার আগে গতকাল দুপুরে মর্গের কাছে বসে তাঁর স্বামী আবাসন ব্যবসায়ী মনিরুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলছিলেন, ‘এতগুলো লাশ শনাক্ত হয়ে গেল। আমার স্ত্রীর লাশটা কি পাব না! এই কষ্ট কিভাবে সহ্য করি? ভাই, বুকটা তো ফেটে যাচ্ছে।’
ওই সময় উম্মে সালমার সহকর্মী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘যারা শনাক্ত হয়েছে তাদের তো কাল নাকি নিয়ে যাবে, আমরা কী করব তা তো বুঝতে পারছি না। আর কত আমরা লাশের জন্য অপেক্ষা করব?’
শাহীন ঢাকায় : দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ১০ বাংলাদেশির মধ্যে গতকাল সকাল পর্যন্ত কাঠমাণ্ডুর দুটি হাসপাতালে ছিলেন তিন বাংলাদেশি। তাঁদের মধ্যে কাঠমাণ্ডু মেডিক্যাল কলেজ (কেএমসি) হাসপাতাল থেকে গতকাল দুপুরে শাহীন ব্যাপারীকে বিমানযোগে বাংলাদেশে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। কেএমসি হাসপাতালে এখন কবীর হোসেন নামের একমাত্র বাংলাদেশি চিকিৎসাধীন। আর নরভিক হাসপাতালে থাকা ইয়াকুব আলীকে গতকাল বিকেলে দিল্লি নেওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।
বাংলাদেশি মেডিক্যাল টিমের সদস্য ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন বিশেষজ্ঞ ডা. হুসাইন ইমাম ইমন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সের সমস্যার কারণে ইয়াকুবকে আজ (রবিবার) বিকেলে পাঠানো যায়নি। তবে কাল (আজ) সকাল ৭টায় তাঁকে নিতে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স কাঠমাণ্ডু আসবে। এ ছাড়া কবীর হোসেনকেও কাল (আজ) ঢাকায় নেওয়া হবে।’
ডা. ইমন বলেন, এর আগে শনিবার রাত দেড়টায় আরেক আহত যাত্রী ইমরানা কবীর হাসিকে নিয়ে কাঠমাণ্ডু ছেড়ে যাওয়া এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সটি সিঙ্গাপুর পৌঁছেছে। সেখানে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তাঁর জরুরি একটি অপারেশন শুরু করা হয়েছে। মারাত্মক সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে তাঁর শরীরের পুড়ে যাওয়া চামড়া অপসারণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে দুই দিন আগে কাঠমাণ্ডু থেকে ওই হাসপাতালে পাঠানো আরেক যাত্রী ডা. রেজওয়ানুল হকের শরীরেও একইভাবে অপারেশন করা হয়েছে।
স্বজনরা যাবে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজে : গতকাল দুপুরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের প্রধান নির্বাহী আসিফ ইমরান কাঠমাণ্ডুতে সাংবাদিকদের জানান, আজ সকাল ১১টায় ইউএস-বাংলার একটি বিশেষ ফ্লাইট আসবে নিহতদের স্বজনদের ঢাকায় নিয়ে যেতে।
কালের কণ্ঠ