প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেশে উন্নয়নের যে ধারা শুরু হয়েছে তা অব্যাহত রাখতে নৌকা প্রতীকের কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের উন্নয়ন হয়। আপনারা নৌকায় ভোট দিন। আমি আপনাদের উন্নয়ন উপহার দেব।’
গতকাল বিকালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পটিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এক বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী জনসভাস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। জনসভায় প্রবেশমুখে ছিল একাধিক দৃষ্টিনন্দন তোরণ। এতে ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্ণিল প্রতিকৃতি। জনসভায় মুক্তিযোদ্ধা ও বিপুলসংখ্যক মহিলার উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের কারণেই আমরা এই দেশ পেয়েছি। তাই সবার আগে তাদের অধিকার। মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি সর্বাগ্রে অধিকার ভোগ করবে। সে কারণে চাকরিতে আমরা কোটার ব্যবস্থা করেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই তো এই চাকরি করতে পারছেন। সুতরাং তাদের ছেলে-মেয়েরা এ সম্মান পাবেন।’ তিনি বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা করে বলেন, ‘আমরা উন্নয়ন করি। আর বিএনপি-জামায়াত জোট মিলে দেশকে পিছিয়ে দেয়। বিগত নির্বাচন ঠেকানোর নামে খালেদা জিয়ার নির্দেশে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। খালেদা ও তার দুই ছেলে কালো টাকা সাদা বানিয়েছেন। তাদের পাচারের টাকা বিদেশে ধরা পড়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর রায় দিয়েছে আদালত। অথচ তার জন্য আন্দোলনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে বিএনপি। তারা রায় মানতে চায় না, আইন মানে না।’ তিনি বলেন, ‘আমার বাবা দেশ স্বাধীন করেছেন দেশের প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবন, শান্তিতে বসবাস করবেন সেই লক্ষ্যে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু যারা এ দেশের স্বাধীনতা চায়নি, তারাই সাড়ে তিন বছরের মাথায় নির্মমভাবে আমার বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। দেশের জন্য আমার পরিবারের সদস্যরা রক্ত দিয়েছেন। আমিও যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। প্রয়োজনে বুকের রক্ত দিয়ে এ দেশের মানুষকে সুন্দর ও উন্নত জীবন দেব।’ তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে আমরা ক্ষমতাসীন হই। ইতিমধ্যে আমাদের সরকার তা পূরণ করেছে। সমগ্র বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে। সবার হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উেক্ষপণ হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষায় সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমরা ১ কোটি ৩০ লাখ মায়ের হাতে উপবৃত্তির টাকা দিচ্ছি। তারা যেন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। কোনো মা যেন অর্ধেক পথে সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ না করেন।’ তিনি বলেন, ‘জনগণের জন্যই আমার রাজনীতি। কাজেই জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন এবং এ দেশকে আমি এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। সারা বিশ্বে আমরা আজ মাথা উঁচু করে কথা বলি। অথচ পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক আমাদের মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল। আমি চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। বিশ্বব্যাংক নয়, নিজেদের অর্থে আমরা পদ্মা সেতু করে দেখাব। তা করে দেখিয়েছি। অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। আল্লাহর রহমতে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে ব্যর্থ, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। বাংলা ভাইয়ের মতো জঙ্গি সৃষ্টি করেছিল। এই চট্টগ্রামেই ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়েছিল। দেশের মানুষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নেই। দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে নেই। সামান্য এতিমের টাকার লোভ যারা সংবরণ করতে পারে না, তাদের সঙ্গে দেশের মানুষ থাকতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় আসি তখন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৬০০ মেগাওয়াট। ২০০১ সালে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিইনি বলে ক্ষমতায় আসতে পারিনি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে এ পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন নিয়ে গেছি ১৬ হাজার মেগাওয়াটে। এর বাইরেও সোলার প্যানেল, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে দেশের মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করেছি।’ দক্ষিণ জেলার সভাপতি মোসলেম উদ্দিনের সভাপতিত্বে জনসভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, হাছান মাহমুদ, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, ব্যারিস্টার চৌধুরী মুহিবুল হাসান নওফেল, ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা, আমিনুল ইসলাম আমিন, বিপ্লব বড়ুয়া, এসএম কামাল হোসেন, নুরুল আলম চৌধুরী, মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আলহাজ সাফিয়া খাতুন প্রমুখ। আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যের আগে চট্টগ্রামের ৪২টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
নৌবাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ নৌবাহনীর পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। নৌবাহিনী নিজেরাই সফলভাবে মহড়ার আয়োজন করছে। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মহড়ায়ও সফলভাবে অংশ নিচ্ছে। তিনি বলেন, উপমহাদেশে কেবল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজই ভূমধ্যসাগরে মাল্টিন্যাশনাল মেরিটাইম টাস্কফোর্সের আওতায় সফলভাবে নিয়োজিত থেকে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে। গতকাল সকালে বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিতে (বিএনএ) বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। পরে নৌবাহিনীর বিভিন্ন যুদ্ধজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বিএন ডকইয়ার্ডকে ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের বিশাল সমুদ্রসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও সমুদ্রে নৌবহরের সব অপারেশনাল কার্যক্রমকে নিরবচ্ছিন্ন রাখার স্বীকৃতি হিসেবে বিএন ডকইয়ার্ডকে ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনী একাডেমিতে পৌঁছলে তাঁকে স্বাগত জানান নৌবাহিনী প্রধান চিফ অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, আমন্ত্রিত অতিথি, নৌবাহিনীর ক্যাডেট ও মিডশিপম্যানরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে ৪২টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। গতকাল বিকালে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত বিশাল জনসভা থেকেই প্রকল্পগুলো তিনি উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
উদ্বোধন করা প্রকল্পসমূহ : চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাবেশস্থল থেকে ১২টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং ২৮টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। উদ্বোধন করা প্রকল্পের মধ্যে আছে— আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ফ্লাইওভার, চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স ভবন, কালুঘাট-মনসার টেক জাতীয় মহাসড়কে (এন-১০৭) ৮ কিলোমিটারের ৮১ দশমিক ৯৮ মিটার দৈর্ঘ্যের পিসি গার্ডার সেতু (মিলিটারি সেতু), পটিয়া-চন্দনাইশ-বৈলতলী সড়কের ৩৪৮ দশমিক ১২ মিটার দৈর্ঘ্যের খোদার হাট সেতু, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুল এন্ড কলেজের আইসিটি সুবিধাসহ পাঁচতলা একাডেমিক ভবন, হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজের আইসিটি সুবিধাসহ পাঁচতলা একাডেমিক ভবন, খলিল মীর কলেজের আইসিটি সুবিধাসহ চারতলা একাডেমিক ভবন, পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রি কলেজের আইসিটি সুবিধাসহ চারতলা একাডেমিক ভবন, ফটিকছড়ির হেয়াকো বনানী কলেজে আইসিটি সুবিধাসহ চারতলা একাডেমিক ভবন, রাঙ্গুনিয়া মহিলা কলেজের আইসিটি সুবিধাসহ পাঁচতলা একাডেমিক ভবন, মিরসরাই প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজে আইসিটি সুবিধাসহ চারতলা একাডেমিক ভবন, নাজিরহাট মাইজভাণ্ডার সড়ক এবং শেখ রাসেল ভাস্কর্য ও পটিয়া দক্ষিণ ভূর্ষি শেখ রাসেল মঞ্চ।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা প্রকল্পসমূহ : জনসভা থেকে যেসব প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে— লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর তীর কালুরঘাট থেকে চাক্তাই পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ, চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন, চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলার সাঙ্গু এবং ডলু নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত ড্রেজিং, অনন্যা ৩৩/১১ কেভি জিআইএস উপকেন্দ নির্মাণ, কল্পলোক ৩৩/১১ এমভিএ নতুন জিআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ, মইজ্জ্যারটেক ৩৩/১১ কেভি এমভিএ নতুন জিআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ, এফআইডিসি কালুরঘাট ৩৩/১১ কেভি এমভিএ নতুন জিআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ, অক্সিজেন ৩৩/১১ কেভি এমভিএ নতুন জিআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ, কাট্টলি ৩৩/১১ কেভি এমভিএ নতুন জিআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ, মনসুরাবাদ ৩৩/১১ কেভি এমভিএ নতুন জিআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ, ১৮০ দশমিক ৩৭৩ মিটার দৈর্ঘ্যের জরাজীর্ণ কালারপোল সেতু পুনর্নির্মাণ, কেরানীহাট-সাতকানিয়া-গুনাগুরি জেলা মহাসড়ক প্রশস্তকরণ, পটিয়া আনোয়ারা-বাঁশখালী টইটং আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্তকরণ।
, ফটিকছড়ির নাজিরহাট-জিসি-কাজিরহাট সড়কে মন্দাকিনি খালের ওপর ৫৪ মিটার দৈর্ঘ্যের আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ, পটিয়ায় পিটিআই একাডেমিক ভবন নির্মাণ, সীতাকুণ্ড টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ওয়ার্কশপ বিল্ডিংসহ পাঁচতলা একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, সরকারি মহিলা কলেজে ১০০ শয্যার ছাত্রীনিবাস নির্মাণ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজে আইসিটি সুবিধাসহ পাঁচতলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ, পোস্তারপাড় চসিক মহিলা কলেজে আইসিটি সুবিধাসহ পাঁচতলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ, পটিয়া পৌর মাল্টিপারপাস কিচেন মার্কেট নির্মাণ, হর্টিকালচার সেন্টার এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর নির্মাণ।