শেয়ারবাজারে ঋণগ্রস্ত কোম্পানি ৯ কোম্পানির ব্যাংক ঋণ ২২ হাজার কোটি টাকা

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট:   শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ঋণ বাড়ছে। ঋণগ্রস্ত এসব কোম্পানির কারণেই সার্বিকভাবে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হতাশায় ভুগছেন। তারা বাজারের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন।

আবার কোনো কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছে। এ কারণে এ ধরনের অনেক কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো কারণে এসব কোম্পানি সমস্যায় পড়লে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের পর বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারবে না।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এসব কোম্পানি একদিকে মুদ্রাবাজারে সংকট তৈরি করছে; পাশাপাশি পুঁজিবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গত ৫ বছরে কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, সে হারে তাদের উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়েনি। এসব টাকা কোম্পানির সম্প্রসারণে ব্যবহার হয়েছে কি-না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম  বলেন, কোম্পানির ঋণ বেশি থাকলে দায় বেড়ে যায়। কারণ কোম্পানি যে মুনাফা করবে, সেখান থেকে সবার আগে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়। এর পর সরকারকে কর দিতে হয়। সবকিছু বাদ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়। আর কোনো কারণে কোম্পানি সংকটে পড়লে সবার আগে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে হয়। ওই বিবেচনায় ইকুইটির চেয়ে ঋণ বেশি হলে কোম্পানি অতিমাত্রায় ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

ডিএসই সূত্র জানায়, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে তারা তালিকাভুক্ত কোম্পানির ব্যাংকের তথ্য হালনাগাদ করছে। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে সরকারি কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড। এ প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ৪৬০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে কোম্পানিটির সর্বশেষ ঋণের স্থিতি ১০ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৭৬ কোটি টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ১০ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা।

তবে ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপানি প্রতিষ্ঠান জাইকার কাছ থেকে। যদিও পাওয়ার গ্রিড এবং ডেসকো সরকারি কোম্পানি। এরপরও এতে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের বোনাস বা রাইট শেয়ার না দিয়ে অতিরিক্ত ঋণের মাধ্যমে কোম্পানির দায় বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান দুটির আরও শেয়ার বাজারে ছাড়ার জন্য সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এসব ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কোনো কর্মকর্তা।

পাওয়ার গ্রিডের চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ  বলেন, সাধারণ কোম্পানির ক্ষেত্রে ঋণ ও মূলধনের অনুপাত প্রযোজ্য। যেসব কোম্পানির আয়-ব্যয় সীমিত, তাদের ক্ষেত্রে এ হিসাব করা যেতে পারে। কিন্তু পাওয়ার গ্রিডের ক্ষেত্রে এ হিসাব প্রযোজ্য হবে না। কারণ এটি অত্যন্ত বড় এবং শক্তিশালী কোম্পানি। এর আয় এবং ব্যয় নিশ্চিত। এ ছাড়া বিদ্যুতের চাহিদা সারা দেশে সব সময় থাকবেই।

সূত্র জানায়, ৪৮ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি এসিআই লিমিটেডের ব্যাংক ঋণ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধিত মূলধনের ৫১ গুণ ঋণ নিয়েছে। এ ছাড়া বিএসআরএম স্টিলের ঋণ ২ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা, গ্রামীণফোন ২ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা, ডেসকো ১ হাজার ২১০ কোটি, বিএসআরএম লিমিটেড ১ হাজার ১২৬ কোটি, এমআই সিমেন্ট ৮৭৩ কোটি এবং কেয়া কসমেটিক্স বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৮৬০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের মূলধন ১১ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ঋণ নিয়েছে ৮৮২ কোটি টাকা। এ ধরনের ৯ কোম্পানির মধ্যে ৮টিই বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দিতে পারেনি।

এ ব্যাপারে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মনজুর শনিবার যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানি ১৯৯৩ সালে যেভাবে শুরু হয়েছিল, এরপর মূলধন আর বাড়ানো হয়নি। কিন্তু ব্যবসা সম্প্রসারণ হওয়ায় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে। তিনি বলেন, ইকুইটির তুলনায় অ্যাপেক্সের ঋণ বেশি হলেও রেভিনিউর (বিক্রি আয়) তুলনায় বেশি নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এটি ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানি নয়। নাসিম মনজুর বলেন, কিছু কোম্পানি ইকুইটি বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। এ কারণে আমরা কম ইকুইটি রেখে বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বাকী খলীলী এ প্রসঙ্গে  বলেন, কিছু কোম্পানি অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে। তার মতে, ঋণঝুঁকি আছে। ঋণ এবং মূলধন মিলিয়ে কোম্পানির এসেট (সম্পদ) কমলে ওই কোম্পানি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোম্পানির আয়ের চেয়ে যদি ঋণ বেশি হয় তবে তা খুবই বিপজ্জনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অন্যদিকে গত তিন বছরে শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ২৮টি কোম্পানি ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণের দায় বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপানো হয়েছে। এসব কোম্পানি প্রিমিয়ামসহ বাজার থেকে ১ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রি ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, প্যাসেফিক ডেনিমস ২৫ কোটি টাকা, ডোরিন পাওয়ার ১৯ কোটি টাকা, ইনফর্মেশন টেকনোলজি ৪ কোটি, কেডিএস এক্সেসরিজ ৭ কোটি, আমান ফিড ৫ কোটি, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং ২০ কোটি ৪০ লাখ, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল ৪৫ কোটি ৩১ লাখ, হামিদ ফেব্রিকস ৩১ কোটি, খান ব্রাদার্স পিপি ২ কোটি, ওয়েস্টার্ন মেরিন ১৩০ কোটি, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং ৭৫ কোটি টাকা, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ফারইস্ট নিটিং ৫৪ কোটি ২ লাখ টাকা, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিল ২৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা, তুংহাই নিটিং ১৬ কোটি, খুলনা প্রিন্টিং ৩০ কোটি টাকা, শাহজিবাজার পাওয়ার ৩১ কোটি ৭০ লাখ, পেনিনসুলা চিটাগং ১৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং এমারেল্ড অয়েল ২০ কোটি ১২ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে।

ডিএসইর পরিচালক মো. রকিবুর রহমান  বলেন, দেশে শিল্পায়নের জন্য আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) অনুমোদন জরুরি। কিন্তু শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। তার মতে, যেসব কোম্পানি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর পরিশোধ করতে পারছে না, সেসব কোম্পানিই শেয়ার বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা তাদের ঋণের দায় বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপাচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।যুগান্তর

Please follow and like us:

Check Also

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বেনজীর আহমেদের সম্পদের তথ্য চাইল দুদক

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।