ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ ভাগ কোটা ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিমঞ্চের ৬ মার্চ সংখ্যায় ‘চাকরির বাজারে কোটা পদ্ধতির বেড়াজাল’ শিরোনামে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর আন্দোলন এগিয়েছে অনেকদূর। শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক আন্দোলন আর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা প্রথা বাতিলের ঘোষণা দেন। পরদিন আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দিলেও ঘটনার নাটকীয়তা থেমে নেই।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর ১১ মার্চ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সাইকেল র্যালি করে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ১৪ মার্চ কোটা সংস্কারের পাঁচ দফা দাবি নিয়ে বিক্ষোভকারীরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে হাইকোর্ট মোড়ে পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং একপর্যায়ে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিপেটার ঘটনায় অনেক ছাত্র আহত হন।
প্রথমে পাঁচজন এবং পরে তাদের ছাড়িয়ে আনতে গেলে পুলিশ আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আটক করে। পরবর্তী সময়ে তাদের ছেড়ে দিলেও অজ্ঞাত ৭০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা দেয় পুলিশ। ১৮ মার্চ মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল পালন করেন তারা।
এর মধ্যে ২১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের এক জনসভায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার ঘোষণা দিলে কোটা সংস্কারের দাবিতে ফের আন্দোলনে নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। চাকরিপ্রত্যাশীরা ২৫ মার্চ গলায় শিক্ষাসনদ ঝুলিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দেয়ার মতো অভিনব কর্মসূচি পালন করে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন।
একইসঙ্গে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজকের শিক্ষার্থী তথা আগামীর চাকরিপ্রত্যাশীদের মাঝে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ চালিয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের লিফলেটে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরা হয়।
এরপর ৮ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা গণপদযাত্রা কর্মসূচিতে নামে। সেদিন দুপুর সোয়া ২ টার দিকে গায়ে কোটা সংস্কারের দাবি সংবলিত টি-শার্ট, হাতে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি নিয়ে অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষার্থী মিছিলসহ গণপদযাত্রা করে শাহবাগ মোড়ে এসে অবস্থান নেন। ওইদিন সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সংসদ থেকে কোটা সংস্কারের দাবি জানাতে থাকেন।
শাহবাগ মোড়ে অবস্থানকালে ছাত্ররা পুলিশকে ফুল দিয়ে তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের কথা জানায়। রাত পৌনে ৮টার দিকে অন্তত ১৫ প্লাটুন দাঙ্গা পুলিশ শিশু পার্কের দিক থেকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা শুরু করে। এসময় আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
রাতভর পুলিশ, ছাত্রলীগ এবং আন্দোলনকারীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আহত ও গ্রেফতার হন। আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগের হামলা থেকে রেহাই পায়নি প্রতিমঞ্চ প্রতিবেদকও।
পরে রাত ১টার দিকে আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ঘটনাস্থলে এসে জানান, প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের দাবির বিষয়ে কথা বলার জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি ৯ এপ্রিল দুপুরে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলবেন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে পুলিশের হামলার প্রতিবাদে রোকেয়া হলের কয়েকশ ছাত্রী গেটের কাছে এসে স্লোগান দিতে থাকে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার হলেও ছাত্রীরা ব্যাপক বিক্ষোভ দেখায়। রাতে একপর্যায়ে গুজব রটে যায় আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থী মারা গেছেন।
এরই মধ্য রাত দেড়টার দিকে ভিসির বাসভবনে তাণ্ডব চালিয়ে টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার, দরজা, জানালা ভেঙে চুরমার করে দেয় অজ্ঞাতরা। গ্যারেজে থাকা ভিসির দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে।
সেদিন ভোরের দিকে পুরো ক্যাম্পাস পুলিশের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলেও কার্জন হল এলাকায় সকাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল আন্দোলনকারী ও পুলিশ সদস্যরা। রাতে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার সময় আশিকুর রহমান নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র বুকে গুলিবিদ্ধ হন।
আন্দোলনকারীরা এ হামলার প্রতিবাদে রাতেই সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেয়। এসময় সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন ৯ এপ্রিল বিকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ে আন্দোলনকারী ২০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেন।
এসময়ের মধ্যে সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে বলে আশ্বাস দেন; কিন্তু আন্দোলনকারীদের বড় একটি অংশ বিপাশা চৌধুরী নামে এক শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে পরের দিন ১০ এপ্রিল আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
আন্দোলন স্থগিতের পর ফের উত্তাপ : অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে ‘আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা’ বলার অভিযোগে ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ‘বাজেটের আগে কোটা সংস্কার হবে না’ বক্তব্যের জের ধরে ফের আন্দোলনে নামেন।
১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীদের উভয় পক্ষ এক হয়ে আবার আন্দোলন শুরু করেন। এ দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগ সভাপতি ইশরাত জাহান ইশা এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছেন এমন গুজবে আন্দোলনে ফের উত্তাপ ছড়ায়।
পরদিন ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কার নয়, গোটা কোটা ব্যবস্থাই বাতিল করার ঘোষণা দিলে শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যান। ১২ এপ্রিল আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ মিছিল করেন। তারা দ্রুত গেজেট প্রকাশের দাবি জানিয়ে আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দেন।
কোটা বাতিলের গেজেট প্রকাশে অগ্রগতি নেই : সরকারি চাকরিতে ৫৬ ভাগ কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আন্দোলনের পর ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন।
একইসঙ্গে তিনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের অন্যভাবে চাকরি দেয়ার কথা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব কাজ করবেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার দুই সপ্তাহ পার হতে চললেও এখনও এ বিষয়ে কোনো কমিটি গঠিত হয়নি। সাধারণত কোটাসংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমকে আহ্বায়ক করে এ বিষয়ে একটি কমিটি হওয়ার কথা রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এ বিষয়ে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে এখনও তেমন কিছু জানা যায়নি। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত আট দিনের সফরে দেশের বাইরে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরায় শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তিন নেতাকে তুলে নেয়ার অভিযোগ : ১৬ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর চানখাঁরপুল থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর, ফারুক আহমেদ ও রাশেদ খানকে তুলে নেয়ার অভিযোগ উঠে ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের কাছ থেকে তথ্য জানার জন্য ডাকা হয়েছিল। অন্যদিকে একই দিনে পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানের বাবাকে ঝিনাইদহ স্থানীয় থানায় ডেকে নিয়ে পুলিশ হয়রানি করেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সুফিয়া কামাল হলে অস্থিরতা : ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগের সভাপতি ইশরাত জাহান ইশাকে ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগে সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। হলের ছাত্রীরা ইশার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে মারধর ও লাঞ্ছিত করেন।
১৩ এপ্রিল ছাত্রলীগ থেকে ও ১৮ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইশাকে লাঞ্ছিত করার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগ থেকে ২৪ জনকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
১৯ এপ্রিল রাতে হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা বেশ কয়েকজন ছাত্রীর অভিভাবককে ডেকে হল থেকে বের করে দেন। অন্তত ২০ ছাত্রীকে হল থেকে বের করে দেয়ায় তোপের মুখে পর দিন শুক্রবার বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে হলে ফিরিয়ে নেয়া হয়। যুগান্তর