ক্রাইমবার্তা রিপোর্ট:সাতক্ষীরা: ২৭ এপ্রিল সাতক্ষীরার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ২০১৪ সালের এ দিনে সাতক্ষীরা শহর শিবিরের সেক্রেটারী আমিনুর রহমান নিহত হন। এসময় গুলিবিদ্ধন হন শহর শিবিরের সভাপতি সহ সাতজন। ইতিহাস হয়ে থাকবে দিনটি। দিনটি আসলে নিহত ও আহত পরিবারের মাঝে নেয়ে আসে শোকের ছায়া। এদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে যারা বেচে আছেন এক অজানা আতঙ্ক তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নিহত আমিনুর রহমানের স্মরণে এ দিনে কুরআন খানি ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন কওে থাকে নিহতের স্বজনরা।
কি হয়ে ছিল সে দিন। সাংবাদিক আব্দুর রাজ্জাক রানার লেখা ২৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাটি হুবুহ তুলে ধরা হল;-
শহর সেক্রেটারি আমিনুর রহমান নিহত ॥ গুলীবিদ্ধ ৭
প্রকাশিত: সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০১৪
# আজ সারাদেশে বিক্ষোভ # সাতক্ষীরায় মঙ্গলবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল # শুক্রবার দোয়া দিবস
সাতক্ষীরায় ছাত্রাবাসের চারপাশ ঘিরে পুলিশ মুহুর্মুহু গুলী চালিয়েছে। এসময় পুলিশের গুলীতে সাতক্ষীরা শহর ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি আমিনুর রহমান (২৭) নিহত হয়েছেন এবং আরো ৭/৮ জন গুলীবিদ্ধ হয়েছেন। তাদেরকে সাতক্ষীরা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রোববার দুপুর ৩টায় সাতক্ষীরা শহরের কামালনগরস্থ মুকুলের বাড়ির ছাত্রবাসে এ ঘটনাটি ঘটে। ঘটনার সময় মুহুর্মুহু গুলীর শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এলাকার সাধারণ মানুষ দিকবিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। পুলিশের ভয়ে অনেকেই বাড়ির প্রধান ফটকে তালা দিয়ে কেউ ঘরের খাটের নীচে আবার কেউ ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন। এলাকাবাসী জানান, হঠাৎ করে যেন মনে হলো এ যেন কোনো যুদ্ধক্ষেত্র। একটি ছাত্রবাসে ছাত্ররা যখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিল তখনই এমন আচমকা ঘটনায় আমরা হতবিহবল হয়ে পড়েছি। এদিকে পুলিশের গুলীতে আমিনুর রহমানের শাহাদৎ বরণের খবর তার গ্রামের বাড়ি কালিগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর গ্রামে পৌঁছালে সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। তার বৃদ্ধ পিতা মফিজউদ্দিন সরদার ও তার মাতা ছবিরন নেছা অপর ছেলে মেয়েদের গলা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারীতে এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। তারা বুক চাপড়াচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, “হে আল্লাহ আমার বাবার কি অপরাধ ছিল। সে তো মানুষদের কুরআনের পথে, হাদিসের পথে ও ইসলামের পথে দাওয়াত দিতো। তার তো আর কেনো অপরাধ ছিলো না। এই অপরাধে পুলিশ যদি আমার বাবাকে মেরে থাকে তাহলে কুরআনের কথা মতো বাবার সঙ্গে জান্নাতে দেখা হবে।” অপরদিকে এলাকার তরুণ ও মেধাবী এই ছাত্রনেতার মৃত্যুতে গোটা সাতক্ষীরা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
এদিকে সাতক্ষীরা শহর ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি আমিনুর রহমানকে হত্যা ও ৭/৮ জন নেতাকর্মী গুলীবিদ্ধের প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ও শুক্রবার দোয়া দিবসের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। রোববার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতে ইসলামী এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সাতক্ষীরা শহরের কামালনগর কবরস্থানের উত্তর পাশে মুকুলের বাড়ির ছাত্রাবাসে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা দুপুরের খাওয়া দাওয়া করছিলেন। হঠাৎ করে দুপুর ৩টার দিকে সাতক্ষীরা সদর থানা ও গোয়েন্দা শাখার পুলিশের একাধিক টিম উক্ত ছাত্রবাসের চারপাশ ঘিরে ফেলে। এসময় ওই ছাত্রবাসকে লক্ষ্য করে পুলিশ মুর্হুমুহু গুলী চালায়। প্রায় আধাঘন্টা ধরে ৬৫ রাউন্ড গুলী চালায়। পুলিশের গুলীতে সাতক্ষীরা শহর ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি আমিনুর রহমান (২৭) নিহত হন। আর সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কল্যাণপুর গ্রামের আবু বকর গাজীর ছেলে মোঃ আবুতালেব (৩০), খুলনা জেলার খানজাহান আলী থানার পাতিয়ারডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল সাত্তারের ছেলে মোঃ আজিজুল ইসলাম (৩০), সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মঙ্গলান্দকাঠি গ্রামের আব্দুল হকের ছেলে শেখ আব্দুল গফুর (২৩), সাতক্ষীরা সদরের ঝাউডাঙ্গা গ্রামের সোহরাব হোসেনের ছেলে নূর মোহাম্মাদ (১৮), তালা উপজেলার মঙ্গলান্দকাঠি গ্রামের আব্দুল হকের ছেলে আব্দুস সবুর (১৮), শ্যামনগর উপজেলার পার্শ্বেখালী গ্রামের মাহবুব গাজীর ছেলে মোঃ ইমরান হোসেন (২৬), খুলনার খানজাহান আলী থানার যুগীপোল গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে মোঃ আক্তার হোসেনকে (২৫) আটক করে রাস্তায় এনে একে একে গুলী করে। পুলিশের নির্মম এই দৃশ্য দেখে এলাকার অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আর বাড়ির মহিলা ও শিশুরা হতভম্ব হয়ে যায়। সকলেই যেন এই দৃশ্য দেখে কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে পড়েন। পরে পুলিশ গুলীবিদ্ধদের রক্তাক্ত অবস্থায় হাত-পা ধরে ধরে গাড়িতে ছুড়ে মারে। এ সময় তারা চিৎকার করে ওঠেন। পুলিশের তত্ত্বাবধানে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
একাধিক গুলীবিদ্ধ নেতা জানান, দুপুরে খাওয়া দাওয়া করার সময় গোয়েন্দা সংস্থার এক সদস্য হঠাৎ করে ছাত্রাবাসের ভেতরে ঢুকে আমিনুর রহমানকে ধরে বুকে গুলী করে। এতে তার কলিজা, ফুসফুস বের হয়ে যায়। এরপর সে তার পায়ে একাধিক গুলী করে। এসময় সে মাটিতে লুটে পড়ে। ছাত্রবাসের ভেতরে থাকা অন্যান্যের ধরে ধরে পায়ে গুলী করে। ছাত্রবাসটি তাদের রক্তে থৈ থৈ করে। আবার কারোর পা রক্তে আটকে যায়।
নিহত আমিনুর রহমান সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের রহমতপুর গ্রামের মফিজউদ্দিন সরদারের ছেলে। ১২ ভাই-বোনের মধ্যে সে ১১তম। ২০০৩ সালে রহমতপুর নবযুগ শিক্ষা সোপান হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৫ সালে শ্যামনগর মহসিন ডিগী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে বাংলা বিভাগ নিয়ে অনার্স-মাস্টার্স করেছে। সে এলাকার একজন তরুণ ও মেধাবী নেতা হিসেবে পরিচিত। আমিনূরের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। তার প্রিয় পিতা-মাতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আর প্রিয় ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। কেউ কারোর কথার জবাব দিতে পারছে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।
তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, লাশ পাওয়ার পর জানাযা ও দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পরিবারের পক্ষ থেকে লাশ নিতে রাতেই সাতক্ষীরায় পৌছেছে। রাতে লাশ দিলে সকালে জানাজা ও দাফন হবে।
সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি এনামুল হক বলেন, সাতক্ষীরা সদর থানাধীন কামালনগর কবরস্থানের উত্তর পাশে মুকুল এর বাড়িতে ছাত্রশিবিরের সাতক্ষীরা পৌর ও কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরা বৈঠক করছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে তার নেতৃত্বে এসআই হান্নান মাহমুদ ও ডিবির সদস্যদের সমন্বয়ে উক্ত অভিযান চালায়। তিনি দাবি করেন ছাত্রশিবিরের কর্মীদের অতর্কিত হামলায় আত্মরক্ষার্থে তারা শর্টগানের গুলী চালায়। প্রায় ২০/২৫ মিনিট ধরে সংঘর্ষ চলাকালে এক পর্যায়ে সাতক্ষীরা শহর সেক্রেটারি আমিনুর রহমান গুলীবিদ্ধ হয় এবং মারা যায়। এছাড়া আরো ৭/৮জন গুলীবিদ্ধ হয়েছে। তাদেরকে গ্রেফতার করে দ্রুত চিকিৎসার জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে দু’টি পিস্তল ও এক রাউন্ড গুলী উদ্ধার করা হয়। এসময় পুলিশ কনস্টেবল আব্দুর রহমান, নূরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর হোসেন ও জিল্লুর রহমান আহত হয়। আহতদেরকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে অভিযানে অংশ নেয়া একাধিক সদস্য জানিয়েছে, উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে খুলনা থেকে গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সদস্য এই অভিযানে অংশ নেয়। তারাই তাদেরকে ধরে ধরে গুলী করেছে। পরে থানার ওসি মিডিয়াতে ফোন করে জানিয়েছে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শিবির নেতা নিহত হয়েছে এবং ৭/৮ জনকে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছে। আর পুলিশের কয়েকজনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসা নিতে বলেছে।
এদিকে সাতক্ষীরা শহর ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি আমিনুর রহমানকে হত্যা ও ৭/৮ জন নেতাকর্মী গুলীবিদ্ধের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন খুলনা মহানগরী জামায়াতের আমীর মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও সেক্রেটারি অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, সাতক্ষীরা জেলা আমীর অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক ম-ল ও সেক্রেটারি নুরুল হুদা, সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রশিবির সভাপতি রুহুল আমীন ও সেক্রেটারি হাবিবুর রহমান।
অপরদিকে সাতক্ষীরা শহর ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি আমিনুর রহমানকে পুলিশ গুলী করে হত্যা ও ৭/৮ শিবির নেতাকে গ্রেফতারের পর গুলী করার প্রতিবাদে খুলনা মহানগরী শিবির প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে। রোববার সন্ধ্যায় নগরীর ডাকবাংলো মোড় হতে মহানগরী শিবির নেতা স.ম. মহিউল ও হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়ে নগরীর কেডিএ ঘোষ রোডে গিয়ে শেষ হয়।
আজ দেশব্যাপী শিবিরের বিক্ষোভ : সাতক্ষীরা শহর শিবিরের সেক্রেটারিকে পুলিশ কর্তৃক গুলী করে হত্যা ও নেতা-কর্মীদের ওপর বেপরোয়া গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে আজ সোমবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ঘোষণা করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
বিবৃতিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল জব্বার ও সেক্রেটারি জেনারেল আতিকুর রহমান বলেন, গতকাল রোববার সাতক্ষীরায় মাসিক রিপোর্টিং বৈঠক চলাকালে পুলিশ অতর্কিত হামলা চালিয়ে শহর শিবিরের সেক্রেটারি আমিনুর রহমানকে গুলী করে হত্যা ও বেপরোয়া গুলী চালিয়ে শহর সভাপতি আবু তালেবসহ ১০ নেতাকে আহত করার প্রতিবাদে সোমবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হবে। শিবিরের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে এ কর্মসূচি পালনের আহ্বান করছি। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আরও কর্মসূচি পরবর্তীতে ঘোষণা করা হবে।