আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: সব বাঁধা কাটিয়ে পঞ্চম বারের মত ইউরোপের বাজারে যাচ্ছে সাতক্ষীরার আম। শনিবার আনুষ্ঠনিক ভাবে সাতক্ষীরা থেকে আম রপ্তানির যাত্রা শুরু হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে আম রফতানি কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরার আম দেশের গন্ডি পেরিয়ে যাবে ইউরোপের বাজারে। ইত্যো মধ্যে বাছাইকৃত পাঁচশ’ চাষিকে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে দেওয়া হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ। জৈব সার, আর্সেনিকমুক্ত পানি ও মাছি-পোকা দমনে ফেরোমন ফাঁদ দিয়েই চলছে বিষমুক্ত আম উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ।
ফ্রুটব্যাগিং পদ্ধতিতে এ বছর এক কোটিরও বেশি রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। রপ্তানিযোগ আম তৈরি করতে সাতক্ষীরাতে ফ্রুটব্যাগিং পদ্ধতি ও জৈব পদ্ধতি গ্রহণ করে চাষীরা। কোন প্রকার বালাই নাশক কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই এ পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করছে সাতক্ষীরার চাষীরা। এদিকে মান যাচাইয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে এবার মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করছে ফল গবেষণা কেন্দ্র।
সূত্র জানায়, সাতক্ষীরার মাটি ও আবহাওয়া আম উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। এ জেলার আম অন্যান্য জেলার চেয়ে ১৫-২০ দিন আগে পাকে। খেতেও বেশ সুস্বাদু। তাই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জকে পেছনে ফেলে রপ্তানি বাজারে বিশেষ গুরুত্ব পায় সাতক্ষীরার ল্যাংড়া, হিমসাগর ও আ¤্রপালি আম।
বিদেশে ভাল দামে আম রফতানি করতে পেরে বেশ আনন্দেই ছিলেন সাতক্ষীরা সহ আম চাষীরা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৮৮ টন আম ইউরোপের বাজারে প্রথম রপ্তানি করা হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮২১ টন আম রফতানি করা হয় মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা কমে আসে ৬৬৫ টনে। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আম রফতানির লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ১০০০ টন। এর মধ্যে ২শ টন আম যাবে সাতক্ষীরা থেকে।
গত বছর ইউরোপে আম রফতানি বাধাগ্রস্থ হওয়ায়, হোঁচট খেয়েছে সম্ভাবনাময় রফতানি বাজার। মান যাচাইয়ের পরীক্ষায় আমে ত্রুটি ধরা পড়ায় তা ফেরত পাঠানো হয় বাংলাদেশে। এতে বিপুল লোকসান গুণতে হয় রফতানিকারকদের। এবার তাই আগেভাগেই আম চাষীরা শুরু করেছেন বিশেষভাবে বাগান পরিচর্যা।
এদিকে, শনিবার সকালে আম রফতানি কর্মসূচি উদ্বোধনের আগে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা অডিটোরিয়ামে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বালাইমুক্ত নিরাপদ আমের বিপণন শীর্ষক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আয়োজনে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেনের সভাপতিত্বে কর্মশালায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে মহাপরিচালক মোহাম্মদ মহাসীন বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ কাজী আব্দুল মান্নান, সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার মো. সাজ্জাদুর রহমান, কৃষিবিদ উইং, পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. আজহার আলী, খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক নিত্যরঞ্জন বিশ^াস, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি ঢাকা কৃষিবিদ আনোয়ার হোসেন, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান বাবু, সলিডারিডাড এর কান্ট্রি ম্যানেজার সেলিম রেজা হাসান, উত্তণের পরিচালক শহিদুল ইসলাম সহ অনেকে বক্তব্য রাখেন।
চুক্তিভিত্তিক চাষের মাধ্যমে উৎপাদিত ‘নিরাপদ’ আম ইউরোপে রপ্তানি শুরু হয়েছে। গত কাল প্রথম চালান গেছে ইউরোপের তিন দেশ ইতালি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যে। এর পর পর্যায়ক্রমে যাবে ইউরোপের অন্যান্য দেশে।
ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে হিমসাগর ও ২২ তারিখের পর থেকে ল্যাংড়া আম এবং ২৮ তারিখের পর থেকে আ¤্রপালি আম বাজারে তুলতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় ৫০ হাজার ৫৯৯ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য চার হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে পাঁচ হাজার ২৯৯টি বাগান পরিচর্যায় করছেন চাষিরা। এর মধ্যে ৮৪টি বাগান বেছে নিয়ে বিদেশে আম রফতানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্র জানান, জেলার সাতটি উপজেলায় চলতি বছর চার হাজার একশ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ১১৯৫ হেক্টর জমিতে, কলারোয়া উপজেলায় ৬০২ হেক্টর, তালা উপজেলায় ৭০৫ হেক্টর, দেবহাটা উপজেলায় ৩৬৮ হেক্টর কালিগঞ্জ উপজেলায় ৮০৫ হেক্টর, আশাশুনি উপজেলায় ১২৫ হেক্টর ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৫০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে।
এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদরে আমের বাগান রয়েছে ১৫৩০টি, কলারোয়ায় ১৩১০টি, তালায় ১৪৫০টি, দেবহাটায় ৪৭৫টি, কালিগঞ্জে ১৪২টি, আশাশুনিতে ১৯০টি ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৫০টি আমের বাগান রয়েছে।
এদিকে ১০ মে জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা আয়োজিত নিরাপদ আম বাজারজাতকরণ বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় ইউরোপের বাজারে আম রপ্তানির সমস্যা ও সম্ভবনা গুলো তুলে ধরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক কাজী আব্দুল মান্নান জানান, গত চার বছর ধরে এ জেলার আম ইউরোপে রফতানি হচ্ছে। এবছর ও শনিবার থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে আম রপ্তানির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আশা করি সাতক্ষীরা থেকে পর্যায় ক্রমে ২শ টন আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এতে সাতক্ষীরা আমী চাষীরা বিপুল পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে আর সরকার পাবে বিপুল অংকের রাজস্ব।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন জানান, সাতক্ষীরার আম ইউরোপের বাজারে বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। আমদানি কারক প্রতিষ্ঠান সমূহ সাতক্ষীরার আম রপ্তানিতে অনেক আগ্রহী। তাই সব বাঁধা কাটিয়ে শনিবার সাতক্ষীরা থেকে আম রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমের গুণাগুণ ক্ষুণœ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে ও তিনি জানান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে মহাপরিচালকমোহাম্মদ মহাসীন বলেন,‘বাংলাদেশের আমের রাজ্য সাতক্ষীরা। দেশে ও বিদেশে চিংড়ির পাশা পাশি আমে যে সুনাম অর্জন করেছে এটা ধরে রাখতে হবে। সাতক্ষীরার আম দেশ ও দেশের বাহিরে আমের চাইতে বেশি সুস্বাদু ও মিষ্টি এবং বিভিন্ন প্রজাতির হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে সাতক্ষীরার আমের চাহিদা অনেক বেশি