ক্রাইমবার্তারিপোট :বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে, নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে, সংসদ ভেঙে দিতে হবে, সেনা মোতায়েন করতে হবে। এ ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না, জনগণ হতে দেবে না।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবিতে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন।
শুক্রবার বিকেল ৩টায় পূর্বঘোষিত এই সমাবেশ শুরু হয়। প্রখর রোদ ও তাপপ্রবাহ উপেক্ষা করে জুমার নামাজের পর থেকেই দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পুরো নয়াপল্টন এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন পর সমাবেশ করার সুযোগ পাওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহের কমতি ছিল না। তাঁরা স্লোগানে স্লোগানে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানান। সমাবেশে শেষ হয় বিকেল সোয়া ৫টায়।
সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজ আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সব রাজনৈতিক দল, সংগঠনকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জনগণের দাবি আদায় করতে হবে। অপশাসনকে পরাজিত করতে হবে। জাতিকে মুক্তি দিতে হবে।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, আমরা বাম মোর্চাকে ধন্যবাদ জানাই। তারা একটি ঐক্য গড়ে তুলেছে। তাই সবাইকে আহ্বান জানাব, গণতন্ত্রকামী সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধ হোন। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করুন। দেশকে স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত করুন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার দেশের অর্থনীতি, গণতন্ত্র, মানুষের কথা বলার অধিকার ধ্বংস করে দিয়েছে। সরকার এ দেশের ব্যাংকগুলো শেষ করে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংককেও শেষ করে দিয়েছে। সেখানে রাখা সোনাগুলো নাকি ধাতু হয়ে গেছে।
কারাবন্দি খালেদা জিয়া প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব বলেন, যে মানুষটি দেশের মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন তাঁকে আজ অন্যয়ভাবে একটি নির্জন কারাগারে আটকে রেখেছে। তিনি এতটাই অসুস্থ তাঁর আত্মীয়রা দেখা করতে গেলে তিনি নিচে আসতে পারেন না। অথচ সরকারের মন্ত্রীররা বলেন, আমরা খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে রাজনীতি করছি। রাজনীতি তো করছে সরকার। কারণ তারা খালেদা জিয়াকে ভয় পায়, সে জন্য তাঁকে কারাগারে আটকে রেখেছে। যে মামলায় তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই, সে মামলায় তাঁকে অন্যায়ভাবে সাজা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখছে।
ফখরুল আরো বলেন, আগে বিএনপি ও বিরোধী নেতাকর্মীদের গুম করতো। এখন নতুন নাটক শুরু হয়েছে। মাদকের নামে নিরপরাধ মানুষকে বিনা বিচারে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। সরকার আজ দেশে একটা ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব শুরু করছে। এ দেশে আজ প্রতিটি মানুষ অনিরাপদ, তাদের কখন কোথায় মৃত্যু হবে কেউ জানে না।
কোটা নিয়ে বিএনপির এ নেতা বলেন, যখন আন্দোলন তুঙ্গে তখন প্রধানমন্ত্রী রেগে সংসদে বলেছেন, কোনো কোটা থাকবে না। আর এখন কি করছে, যারা আন্দোলনের সাথে জড়িত তাদের গুম করা হচ্ছে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করছে। এখন ছাত্রলীগের ভূমিকা পাকিস্তান আমলে ইয়াহিয়া খানের ছাত্র সংগঠনের মতো। আজ দেশে কেউ নিরাপদ নয়। কেউ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে না।
শুক্রবার দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়। আমাদের এমপি-মন্ত্রী বানানোর জন্য নয়। আমরা আন্দোলন করছি, কথা বলার অধিকার ফিরে পেতে, ভোটের অধিকার ফিরে পেতে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে। কিন্তু এটি সরকার দেবে না। কারণ যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হয় তাহলে আওয়ামী লীগ ২০টি আসনও পাবে না। তাই এ সরকারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। আন্দোলনের মাধ্যমে এদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে, বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল।
বিক্ষোভ সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা অনেকবার সভা করতে চেয়েছি। আমাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। আজকের সভা করতে অনুমতি দিয়েছে, তাও মৌখিকভাবে। আমাদের যদি মঞ্চ করে সভা-সমাবেশ করতে দিত, তাহলে কাল প্রধানমন্ত্রী যে সভা করবেন তার চেয়ে বেশি লোক হতো। এ সরকার আমাদের সভা করতে দেয় না, কারণ তারা বিএনপি ও খালেদা জিয়কে ভয় পায়।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, এ সরকারের জনগণের ওপর আস্থা নাই, তাই আবারও ৫ জানুয়ারি মার্কা একটি প্রহসনের নির্বাচন করতে চায়। আর সেজন্য অন্যায়ভাবে খালেদা জিয়াকে কারাগারে আটকে রেখেছে। তাঁকে চিকিৎসাসেবা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। তার একটি কারণ, তারা বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে বাইরে রেখে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ক্ষমতা দখল করতে চায়।
বিএনপির এ নেতা বলেন, এ সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে দেশের তিনটি প্রধান স্তম্ভ নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সংসদকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা দেশের প্রধান বিচারপতিকে জোর করে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, দেশের জনগণ এ সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। এ ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না। খালেদা জিয়ার মুক্ত না হলে এ দেশে কোনো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে চাইলে এবার আর জনগণ বসে থাকবে না। আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের নেত্রীকে মুক্ত করে দাবি আদায় করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, আগামী তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জনগণ কোনো ভোট কারচুপির নির্বাচন হতে দেবে না। আর আগামী নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে হবে না। কারণ এরই মাঝে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে জনগণ দেখেছে শেখ হাসিনার অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। তাই আগামী নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে, সংসদ ভেঙে দিতে হবে, বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন করতে হবে, নিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিক্ষোভ সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, স্লোগান দিয়ে কাজ হবে না। কাজ করতে হবে, রাজপথে আন্দোলন করতে হবে। সবাইকে মাঠের আন্দোলনের জন্য তৈরি থাকতে হবে।
মওদুদ বলেন, আজকে একটি বিনা ভোটের সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে দেশ চালাচ্ছে। তাই দেশের জনগণের জন্য এ সরকারকে অপসারণ করতে হবে। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এসব করতে হলে আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে সবার আগে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। আইনি প্রক্রিয়ায় না হলে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁকে মুক্ত করতে হবে।
ব্যারিস্টার মওদুদ আরো বলেন, যদি দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চান তাহলে সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে। কারণ এক দলের নেত্রী জেলে থাকবেন, আর একজন সরকারি খরচে সভা-সমাবেশ করে ভোট চাইবেন, তা হবে না।
মওদুদ বলেন, আমাদের সভা করতে মাসের পর মাস অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সামনে আমরা আর অনুমতি চাইব না। সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেব এবং সেটি পুলিশকে জানিয়ে দেব আমরা অমুক দিন অমুক জায়গাতে সভা করব।
ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়া যাবে না
বিএনপির স্থায়ী কমিটির মির্জা আব্বাস বলেন, আমরা খালেদা জিয়াকে নিয়ে নির্বাচন যাবে। কেউ যদি মনে করেন, ফাঁকা মাঠে গোল দেবেন তাহলে ভুল করবেন। আমরা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাব। এ ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না।
মির্জা আব্বাস বলেন, এদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থায় কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেটি কারো বুঝতে বাকি নেই। কারণ ঢাকা মহানগরের এক নেতা বরিশালের পুলিশ কমিশনারের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েছে। তাহলে দেশের অবস্থা কী আপনারা বুঝেন।
সরকারের উদ্দেশে মির্জা আব্বাস বলেন, যারা নির্যাতন করছে তারা কেউ মাফ পায়নি। তাই জনগণকে নির্যাতন করবেন না। আমরা এটা স্পষ্ট করে বলতে চাই, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব। এর বাইরে কোনো নির্বাচন হবে না। আর ভোটের আগে এ নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই পুনর্গঠন করতে হবে।
এই সরকারের অধীনের নির্বাচন হবে না
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সমাবেশে বলেন, বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে আর কোনো নির্বাচন নয়। এ সরকার এ দেশের বৈধ সরকার নয়। তাই তাদের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না।
ভারতের উদ্দেশে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বাংলাদেশের একটি দলের সঙ্গে বন্ধুত্ব মানে এ দেশের জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব নয়। তাই বন্ধুত্ব করতে হলে জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে দিল্লির গোলামি করতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা হবে এদেশের জনগণের ভোটে নিবাচিত জনপ্রতিনিধি দিয়ে। ভিন দেশের কারো সমর্থন নিয়ে নয়। সাবধান, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবেন না। এদেশের মানুষ সহ্য করবে না।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই, সরকারের পদত্যাগ চাই, নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ চাই। এর আগে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন। আর যেদিন খালেদা জিয়ার মুক্ত হবেন সে দিন দেশের গণতন্ত্র মুক্ত হবে।’
আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাব
বিক্ষোভ সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করব।
মঈন খান বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাব। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা হবে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায়, সেলিমা রহমান ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জয়নুল আবদীন ফারুক, আবুল খায়ের ভুঁইয়া ও আমান উল্লাহ আমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া, বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ ও সহদপ্তর সম্পাদক বেলাল আহমদ প্রমুখ।