শুরুতেই হোঁচট যুক্তফ্রন্টের:তৃতীয় শক্তির প্রতিষ্ঠা না আসানের দর-কষাকষি

প্রয়োজনে সবার সঙ্গে কথা বলবে বিএনপি * কাদের সিদ্দিকী ফ্রন্টের সদস্য নন -মাহী বি চৌধুরী * ড. কামাল হোসেনকে বাইরে রেখে যুক্তফ্রন্ট করতে আগ্রহী নই -ইকবাল সিদ্দিকী

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট:  দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য চার দল মিলে গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু সেখানে শুরুতেই নেতৃত্বের কোন্দল দেখা দিয়েছে। জোটের নেতৃত্বে নির্বাচন ও বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছে।

বিশেষ করে ড. কামালকে যুক্তফ্রন্টে যুক্ত করা নিয়ে তীব্র মতানৈক্য বিরাজ করছে। ফলে রাজনীতির মাঠে আলোচনা শুরু হয়েছে যুক্তফ্রন্টের উদ্যোগ কি তাহলে ভেস্তে যাচ্ছে? যুক্তফ্রন্টে সৃষ্ট মতবিরোধ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি।

শুক্রবার যুক্তফ্রন্টের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত দলগুলোর আলাদা দুটি সংবাদ সম্মেলন আয়োজন এবং সেখানে তাদের বক্তব্য তেমন ইঙ্গিতই বহন করছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, ফ্রন্টের এক শরিক অপর একটি দলের নেতাকে উদ্দেশ করে বলছেন তিনি ফ্রন্টের সদস্য নন।

সেদিক থেকে কোন কোন দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট হবে সেটাই এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ অবস্থায় বিএনপির কাছে তারা আসন দাবি করে বসেছেন। তারা বলেন, যুক্তফ্রন্ট আসলেই কি তৃতীয় শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায়, না আগামী নির্বাচন পার করার জন্য কিছু আসনের ভাগ চায়- এটা আগে নিশ্চিত করতে হবে।

এদিকে শুক্রবার সাভারে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্টের ডাকা সমাবেশেও উপস্থিত হননি কাদের সিদ্দিকী। প্রকাশ্যে এ ধরনের বিরোধের পরও দলটির নেতাদের দাবি- আগামী দিনে একটি অর্থবহ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তারা কাজ করছেন।

নিজেদের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ তৈরি হলেও খুব শিগগির তা দূর হবে। যুক্তফ্রন্টের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদ দূর করতে প্রয়োজনে ফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে বসার কথাও ভাবছেন বিএনপির নেতারা।

জানা গেছে, চারদলীয় জোটের শরিকদের মতবিরোধ রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এ ইস্যুতে নানা ধরনের ঢালপালা মেলতে শুরু করে। বৃহত্তর ঐক্য যাতে না হয় সে জন্য তৃতীয় কোনো শক্তি পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তে পারে- এমন শঙ্কা করছেন মাঠের বিরোধী দল বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।

তারা মনে করেন, বিএনপিকে দুর্বল করার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে একটি মহল খেলার চেষ্টা করছে। জামায়াতে ইসলাম যাতে বিএনপির জোটে না থাকে সে জন্য দলটির নেতাদের নানা ধরনের টোপ এবং ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। একই মহল যুক্তফ্রন্টের শরিকদের কাঁধেও ভর করেছে।

তারা চাচ্ছে না নতুন জোটটি মাঠে সক্রিয় হোক। বিএনপির সঙ্গে যাতে তারা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে না পারে সে জন্যই এত কিছু হচ্ছে। মূলত এসব কারণেই বিএনপির নেতারা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। নেতারা যেমন জামায়াতের সঙ্গে সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলছেন।

একইভাবে তারা যুক্তফ্রন্টের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদ দূর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। দরকার হলে ফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা আলাদাভাবে বসার কথাও ভাবছেন।

তারা মনে করেন, শুরুতেই যুক্তফ্রন্টে ভাঙনের সৃষ্টি হলে বৃহত্তর ঐক্য গঠনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে পাঁচ রাজনীতিক- গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিকল্পধারার সভাপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকী ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না একটি বিকল্প জোট গঠনের চেষ্টা চালান।

জোট গঠনের বিষয়ে বেশ কয়েকবার তারা গণমাধ্যমে কথাও বলেছেন। সবশেষ গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে আ স ম রবের বাসায় ড. কামাল হোসেনকে বাইরে রেখে জোটের ঘোষণা দেন বাকি চার নেতা। নাম দেয়া হয় ‘যুক্তফ্রন্ট’।

ওই বৈঠকে জোটের চেয়ারম্যান করা হয় বি. চৌধুরীকে আর সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয় মান্নাকে। সে সময় কামাল হোসেন দেশের বাইরে থাকায় তিনি এ জোটে আসেননি বলে জানানো হয়। তবে দেশে ফিরে কামাল হোসেন জোটে যোগ দেননি।

সূত্র জানায়, বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক বিকল্পধারার সভাপতি বি. চৌধুরীর সঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠক করেন।

সেখানে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। ঐক্যের ব্যাপারে তাদের মধ্যে চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়। বিএনপির কাছে দেড়শ’ আসন চেয়েছে যুক্তফ্রন্ট- গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ক্ষুব্ধ হয় ফ্রন্টের শরিকরা।

তাদের সঙ্গে আলাপ না করে কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হলো তা নানা মাধ্যমে জানতে চাওয়া হয়। শরিকদের ক্ষোভ নিরসন ও পরবর্তী করণীয় চূড়ান্ত করতে বৃহস্পতিবার ফ্রন্টের বৈঠক ডাকেন বি. চৌধুরী।

কিন্তু বৈঠকে যুক্তফ্রন্টে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে যুক্ত করা নিয়ে নতুন করে মতপার্থক্য দেখা দেয়। বৈঠকে কাদের সিদ্দিকী প্রস্তাব করেন, ড. কামাল হোসেনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কিন্তু এর বিরোধিতা করে অন্যরা।

সূত্র জানায়, ড. কামাল হোসেনকে যুক্তফ্রন্টে আনার ক্ষেত্রে অনাগ্রহের অন্যতম কারণ হচ্ছে নেতৃত্ব। তাকে অনুরোধ করে জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হলে বৃহত্তর ঐক্যের রূপকার ড. কামাল হোসেনকে মূল নেতৃত্ব দেয়ার দাবি উঠতে পারে বলে মনে করে একটি অংশ।

তবে তিনি যদি স্বেচ্ছায় আসতে চান তাহলে সমস্যা নেই। এলে তাকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হবে। কিন্তু কাদের সিদ্দিকী চাচ্ছেন ফ্রন্টের আহ্বায়ক বি. চৌধুরী যেন ফোন করে ড. কামাল হোসেনকে ফ্রন্টে আসার প্রস্তাব দেন। কিন্তু এতে রাজি নন বি. চৌধুরী।

বৃহস্পতিবারের বৈঠকের পর শুক্রবার সকালে ও বিকালে ফ্রন্টের শরিকরা আলাদা সংবাদ সম্মেলন করেন। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে।

যুক্তফ্রন্টের মতবিরোধ প্রসঙ্গে ফ্রন্টের এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, পাগল যদি পাগলামি করে তবে কিছুটা ছাড় দিতে হয়। উল্টো তার সঙ্গে পাগলামি করলে তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক আ স ম আবদুর রব বলেন, যুক্তফ্রন্ট এখনও আনুষ্ঠানিক রূপ পায়নি। আমরা চূড়ান্ত রূপ দেয়ার চেষ্টা করছি। এ সময় চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কারও মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ থাকতে পারে। তবে চূড়ান্তরূপে আসার আগে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

শরিকদের মধ্যে মতবিরোধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, উনি (কাদের সিদ্দিকী) উনার মতামত দিয়েছেন। আমরাও চাই উনি (ড. কামাল হোসেন) আসুক। প্রথমদিকে উনি তো ছিলেন। কিন্তু জোট গঠনের সময় তিনি এলেন না। সেটি নিয়ে জোটের বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। কিছু সমস্যা আছে যা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হয়ে যাবে।

মাহী বি চৌধুরী বলেন, যুক্তফ্রন্টে কোনো মতবিরোধ নেই। আমাদের সবার বক্তব্যই এক। আমাদের ফ্রন্টের অবস্থান স্পষ্ট। জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় আমরা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে চাই। তবে তা হতে হবে ভারসাম্যের ভিত্তিতে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাদের সিদ্দিকী এখনও যুক্তফ্রন্টের সদস্য নন। তিনি জানিয়েছেন ড. কামাল হোসেনকে না নিয়ে আসবেন না। ঠিক আছে আমরা বলছি উনাকে নিয়ে আসেন। তারা ফ্রন্টে এলে স্বাগত জানাব।

অন্যদিকে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের অবস্থান স্পষ্ট। অন্য শরিকদের তারা সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে। জানতে চাইলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী যুগান্তরকে বলেন, ফ্রন্টে তেমন মতবিরোধ নেই।

আমরা চাচ্ছি জোট বা বৃহত্তর ঐক্য যাই হোক, সেখানে বি. চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনকে রাখতে হবে। কামাল হোসেনকে বাইরে রেখে আমরা যুক্তফ্রন্ট করতে আগ্রহী নই। তেমনি বি. চৌধুরীকে বাদ দিয়েও আমরা কিছু করতে চাই না।

এদিকে যুক্তফ্রন্টের এমন মতবিরোধকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, দেশ বাঁচাতে আমাদের নেত্রী বৃহত্তর ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তি নিয়ে আমরা এ ঐক্য গড়ে তুলতে চাই।

আমাদের দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এ নিয়ে কাজ করছেন। আশা করি, দেশের স্বার্থে সব দল একই প্লাটফর্মে আসবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা শুধু যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে চাই না। ফ্রন্ট ছাড়াও আরও কয়েকটি দল এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে।

কোনো জোটের শরিকদের মধ্যে চাওয়া-পাওয়া বা নেতৃত্ব নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও সেটা ওই জোটের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। মতবিরোধ তো বৃহত্তর ঐক্যকে ইস্যু করে হয়নি।

গয়েশ্বর বলেন, এ মতবিরোধের পেছনে অন্য কোনো শক্তিও ইন্ধন জোগাতে পারে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে প্রয়োজনে আলাদাভাবে কথা হবে বলেও জানান বিএনপির এই নীতিনির্ধারক।যুগান্তর

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।