সিলেটে উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় বিরোধী প্রার্থীরা

কবির আহমদ, সিলেট : সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) ৪র্থ তম  নির্বাচনের ভোট গ্রহণ আজ সোমবার। প্রবাসী অধ্যুষিত আধ্যাত্মিক নগরী হিসেবে খ্যাত সিসিক নির্বাচনের ভোট গ্রহণে প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। সরেজমিনে সিসিকের ১৩টি কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ ভোটের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তারা কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। কিন্তু উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় রয়েছেন বিরোধী মেয়র প্রার্থীরা। বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী শনিবার রাত ১১টায় তার প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় মিতা কমিউনিটি সেন্টারে আজকের নির্বাচনে তার উদ্বেগ-উৎকন্ঠার কথা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন। শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় আরিফুল হক চৌধুরীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় মহানগর পুলিশ। আরিফ আরো জানিয়েছেন বিএনপি নেতাদের গ্রেপ্তারের জন্য ১৩৯ জন পুলিশ সদস্যকে ঢাকা থেকে সিলেটে নিয়ে আসা হয়েছে। গণহারে ধরপাকরকে কেন্দ্র করে শান্তিপূর্ণ নগরী সিলেটের ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার পরিবর্তে হতাশা বিরাজ করছে। সিলেট নাগরিক ফোরামের অপর প্রার্থী পরিচ্ছন্ন ইমেজের অধিকারী এডভোকেট এহাসানুল মাহবুব জুবায়ের গতকাল রোববার বিকেলে সিলেট আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে গিয়ে রিটার্নিং অফিসারের কাছে আজকের ভোটগ্রহণ নিয়ে তার উদ্বেগ-উৎকন্ঠার কথা জানিয়েছেন। নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন টেবিল ঘড়ি মার্কার প্রার্থী জুবায়ের।
এদিকে, সিসিক নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার আলীমুজ্জামান বলছেন অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন সিলেটের মানুষকে উপহার দিতে প্রস্তুত রয়েছে নির্বাচন কমিশন। তিনি জানান, ইতোমধ্যে নগর জুড়ে চার স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে ১৪ প্লাটুন বিজিবিসহ র‌্যাব-পুলিশের অন্তত ৫ হাজার সদস্য। মাঠে নেমেছেন ১৮ ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাচন কমিশনের ১১ পর্যবেক্ষক। ঝুঁকিপূর্ণ ৮০টি ভোট কেন্দ্রকে ঘিরে নেয়া হয়েছে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তিনি আরো জানান, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যে নির্বাচন কমিশন বদ্ধপরিকর। গতকাল রোববার সকাল থেকে নির্বাচনী সরঞ্জাম কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছানো হয়েছে।
কোতোয়ালির অধিকাংশ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ
পুলিশ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ১৩৪ টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৮০টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা। নির্বাচন কমিশনের ভাষায়-এই ভোট কেন্দ্রের নাম ‘অধিক গুরুত্বপূর্ণ’। ঝুঁকিপূর্ণ ৮০ কেন্দ্রের মধ্যে শুধুমাত্র কোতোয়ালি থানা এলাকায়ই রয়েছে ৪০ ভোট কেন্দ্র। সূত্র জানায়, কোতোয়ালী থানা এলাকায় ১৫ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪০টি ঝুঁকিপূর্ণ ও ২৭টি সাধারণ, দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকায় ২টি ওয়ার্ডের ৬টি ঝুঁকিপূর্ণ, জালালাবাদ থানা এলাকার ১টি ওয়ার্ডের ৪টি কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ, এয়ারপোর্ট থানা এলাকার ৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ১১ টি ও সাধারণ কেন্দ্র ১২টি, মোগলাবাজার থানা এলাকার ১টি ওয়ার্ডের ৫ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ ও শাহপরান থানা এলাকার ৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ভোট কেন্দ্র ১৪টি ও সাধারণ ভোট কেন্দ্র রয়েছে ৫টি। ১৩৪ ভোট কেন্দ্রের মধ্যে কোতয়ালি থানায় ৬৭ টি, দক্ষিণ সুরমা থানায় ১২টি, জালালাবাদ থানায় ৮টি, এয়ারপোর্ট থানায় ২৩টি, মোগলাবাজার থানায় ৫টি ও শাহপরান থানায় ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৯টি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৩ হাজার সদস্য প্রস্তুত
নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করবেন আইন শৃংখলা বাহিনীর ৩ হাজার ১০৮ জন সদস্য। এর মধ্যে ১৩৬ জন এস আইসহ পুলিশের ৯৩৮ সদস্য, ব্যাটালিয়ন ও সাধারণ আনসার মিলে ২ হাজা ১৭০ জন আনসার সদস্য। ঝুঁকিপূর্ণ প্রতি কেন্দ্রে থাকবেন ২৪ জন ও সাধারণ ভোট কেন্দ্রে থাকবেন ২২ জন। সে হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ ৮০ ভোট কেন্দ্রে ১ হাজার ৯২০ জন ও সাধারণ ভোট কেন্দ্রে ১ হাজার ১৮৮ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।
থাকবেন আরো ২ হাজার সদস্য
নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভোট কেন্দ্রের বাইরে ভোট কেন্দ্রের আশপাশ এলাকায় ভোটারদের নিরাপত্তায় থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরো ২ হাজার সদস্য। বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, আর্মড পুলিশ, আনসারসহ সব মিলিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যে আইনশৃংখলা বাহিনীর অন্তত ৫ হাজার সদস্য মাঠে রয়েছেন।
প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যে ভোট গ্রহণের জন্যে নিয়োগকৃত ২ হাজার ৯১২ জন ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন-১৩৪ জন প্রিসাইডিং অফিসার, ৯২৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ১ হাজার ৮৫২ জন পোলিং অফিসার। রোববার রাতে ভোট কেন্দ্রে অবস্থানের পর আজ সোমবার সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু করবেন তারা।
আছেন ১৮ ম্যাজিস্ট্রেট
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল রোববার থেকে আগামী ১ আগস্ট বুধবার পর্যন্ত নগরীতে দায়িত্ব পালন করবেন ১৮ ম্যাজিস্ট্রেট। এর মধ্যে ৯ জন হলেন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং ৯ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ নির্বাচনী অপরাধসমূহ আমলে নিয়ে তাৎক্ষণিক বিচারিক আদালত পরিচালনা করবেন। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিজিবি সদস্যদেরও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন বলে নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ পুলিশের স্ট্রাইকিং ফোর্সকে নির্দেশনা দেবেন। প্রতি ৩ ওয়ার্ডের জন্যে থাকবেন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
মাঠে নেমেছেন ১১ পর্যবেক্ষক
অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এবং প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের নির্বাচনের পরিস্থিতি নিবিড় ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণের জন্যে গতকাল রোববার থেকে মাঠে নামছেন নির্বাচন কমিশনের নিয়োগকৃত ১১ পর্যবেক্ষক। নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট’র মহাপরিচালক মোস্তফা ফারুককে প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী করে গঠিত পর্যবেক্ষক টিমের অন্যদের মধ্যে ৫ জন হলেন জেলা নির্বাচন অফিসার ও ৫ জন উপজেলা নির্বাচন অফিসার। নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই, আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি, ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা প্রদান, জাল ভোট, অবৈধ প্রভাব বিস্তার রোধে পর্যবেক্ষকরা দায়িত্ব পালন করবেন। কোন অনিয়ম ও ত্রুটি বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে তা তাৎক্ষনিক রিটার্নিং অফিসার থেকে শুরু করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পর্যন্ত জানাতে হবে পর্যবেক্ষকদের।
ভোটের লড়াইয়ে ১৯৫ প্রার্থী
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অনুষ্ঠিতব্য ৪র্থ এই নির্বাচনে মেয়র, সংরক্ষিত কাউন্সিলর ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে মোট ১৯৫ জন প্রার্থী ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। এর মধ্যে মেয়র পদে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ধানের শীষ প্রতীকে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান নৌকা প্রতীকে, সিলেট নাগরিক ফোরামের প্রার্থী ও নগর জামায়াতের আমীর এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের টেবিল ঘড়ি প্রতীকে, বাসদ মনোনীত প্রার্থী আবু জাফর মই প্রতীকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রফেসর ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন খান হাতপাখা প্রতীকে ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এহছানুল হক তাহের হরিণ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সংরক্ষিত আসনের ৯টি ওয়ার্ডে ৬২ জন ও ২৭ টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ১২৭ প্রার্থী।
মোট ভোটার ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন
সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এবার মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪ জন ও মহিলা ভোটার হলেন ১ লাখ ৫০ হাজার ২৮৮ জন। এবার মোট ভোট কেন্দ্র ১৩৪ টি ও ভোটকক্ষের সংখ্যা ৯২৬টি। এর মধ্যে অস্থায়ী ভোটকক্ষ হল ৩৪টি। ২০১৩ সালের ১৫ জুন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৩য় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৪৬ জন। সে হিসেবে গত নির্বাচনের চেয়ে এবার ৩০ হাজার ৬৪৮ জন ভোটার বেড়েছে।

Please follow and like us:

Check Also

ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তান নিয়ে ট্রেনের নিচে নারীর ঝাঁপ: মারা যান মা-ছেলে

হাজীগঞ্জে এক বছরের সন্তান আব্দুর রহমানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেন মা তাহমিনা (২৩)। এতে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।