টিআইবির খানা জরিপ প্রত্যাখ্যান পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের

ক্রাইসবার্তা ডেস্করির্পোটঃট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) খানা জরিপের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। তাদের বক্তব্য, শুধু শ্রুতিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা একটি প্রতিবেদন কতটা যৌক্তিক বা সঠিক, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে পূর্বধারণাবশত ভিত্তির ওপর পুলিশকে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আজ এক বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন তাদের বক্তব্য তুলে ধরে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার ও পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের দপ্তর সম্পাদক গণমাধ্যমে এ বক্তব্য পাঠান।

গত ৩০ আগস্ট টিআইবির ২০১৭ সালের খানা জরিপ প্রকাশিত হয়। জরিপের তথ্য অনুসারে দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এই সংস্থার কাছে সেবা নিতে গিয়ে ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ খানা কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন বাধ্য হয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছ থেকে সেবা নিতে গিয়ে গড়ে প্রতিটি খানাকে ৬ হাজার ৯৭২ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

জরিপের তথ্য অনুসারে সেবাগ্রহীতারা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন হাইওয়ে পুলিশের দ্বারা (৯২ দশমিক ১ শতাংশ)। আর সবচেয়ে কম হয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের হাতে (৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ)। এ ছাড়া স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাছ থেকে সেবা নিতে গিয়ে ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, গ্রেপ্তারসংক্রান্ত বিষয়ে সেবা নিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছ থেকে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন সেবাগ্রহীতারা।
পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, সেবা খাতে দুর্নীতির জরিপের জন্য মাত্র ১৫ হাজার ৫৮১টি খানার (গবেষণা প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা-১৪) মতামত নেওয়া হয়েছে, যা মোট খানার মাত্র দশমিক শূন্য ৪১৭ শতাংশ (গবেষণা প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা-২২)। এ রকম কমসংখ্যক খানার ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতার ধারণাপ্রসূত মতামতের ভিত্তিতে বাংলাদেশ পুলিশের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ও সেবামূলক সংস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশের উন্নয়নের ধারা সমুন্নত রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করা এই বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে এই ধরনের অপরিপক্ব ও পূর্বধারণাপ্রসূত গবেষণার প্রকাশ বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে হতাশ করেছে।
অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, টিআইবির গবেষণায় একই উপাত্তের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অঙ্কে উপস্থাপন এবং দুবার উপস্থাপন প্রতিবেদনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একই সারণিতে শতাংশের হিসাবে গরমিল, উপাত্তের মানের গরমিল ও একই উপাত্তের দুবার ব্যবহার কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়, টিআইবি প্রকৃত গবেষণা ছাড়াই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মনগড়া উপাত্ত ব্যবহার করেছে।
পলিশ সদস্যদের সংগঠনটি বলছে, গবেষণাকর্মে দুর্নীতি ও অনিয়মকে সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্যে আইনগত ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। প্রচলিত আইনে দুর্নীতিকে সংজ্ঞায়িত করা হলেও গবেষণা জরিপে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। জরিপে দেখা গেছে, স্নাতক ও তদূর্ধ্ব খানার চেয়ে নিরক্ষর ও স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন খানার পূর্বধারণাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অধিকন্তু সেবা খাতের আলোচ্য গবেষণায় প্রশ্নমালা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা দেখানো হয়েছে। কিছু সেবার ক্ষেত্রে যেমন ঘুষ প্রদানে কে, কার জন্য ও কেন ঘুষ চেয়েছে, এভাবে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে প্রশ্নমালার প্রশ্নে উত্তরদাতা যাতে অস্পষ্ট উত্তর দেয়, এমন প্রশ্ন করা হয়েছে। এ ধরনের প্রশ্নমালার মাধ্যমে প্রাপ্ত মতামত জরিপের ফলাফলকে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, জরিপে সেবার খাত হিসেবে ট্রাফিক পুলিশকে দেখানো হয়েছে। কিন্তু খানাগুলো ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকে কি ধরনের সেবা নিয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। উল্লেখ্য, যে সব খানা ট্রাফিক পুলিশের সংস্পর্শে আসে তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারী। এ ছাড়া খানা প্রতি ট্রাফিক পুলিশকে গড় ঘুষ প্রদানের পরিমাণ ৫ হাজার ৮৮২ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে যা সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব (গবেষণা প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা-২৯)। এ ক্ষেত্রে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক আইনে প্রসিকিউশন পর্যালোচনায় দেখা যায় গড় জরিমানার হার মাত্র ৫০০ টাকা। ঢাকার বাইরে এ জরিমানার হার আরও কম। যেখানে ৫০০ টাকার কমে জরিমানা দেওয়ার মাধ্যমে ট্রাফিক আইনে প্রসিকিউশন নিষ্পত্তি করা সম্ভব সেখানে ৫ হাজার ৮৮২ টাকা ঘুষ প্রদানের বিষয়টি জরিপকারী সংস্থার কল্পনাপ্রসূত এবং অতিরঞ্জন বলে প্রতীয়মান হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গবেষণা প্রতিবেদনের সারণি ৪.২ তে জিডি সেবা ২০ শতাংশ এবং এফআইআর সেবা ১১ দশমিক ১ শতাংশ গ্রহণকারী রয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে (গবেষণা প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা-২৯)। বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, জিডি ও এফআইআর এর অনুপাত প্রায় ২ অনুপাত ১। প্রকৃতপক্ষে সারা দেশে তদন্তযোগ্য জিডি ও এফআইআরের অনুপাত প্রায় ২০ অনুপাত ১। এতে প্রতীয়মান হয় যে, তথ্য সংগ্রহের বেলায় তথ্যদাতা বা খানা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দৈবচয়ন পদ্ধতি অনুসরণ না করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে টার্গেটভিত্তিক মামলায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বেছে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের মতো শৃঙ্খলা বাহিনীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হেয় করার হীন উদ্দেশ্যে এ ধরনের জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।
পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বাংলাদেশ পুলিশকে শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে দেশের অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণের নিমিত্ত কোনো ঘটনার পক্ষ ও প্রতিপক্ষ উভয়কে নিয়ে কাজ করতে হয়। পুলিশ সব সময়ই প্রাপ্ত অভিযোগ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের পর রিপোর্ট দাখিল করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত পক্ষ সর্বদাই পুলিশের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে থাকে। অপরদিকে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি প্রদান করে ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করা হলে বাদীপক্ষ পুলিশের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে থাকে বিধায় পুলিশের পক্ষে উভয় পক্ষকে কখনোই সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয় না।
তাদের বক্তব্য, বাংলাদেশ পুলিশ সবচেয়ে দৃশ্যমান একটি পেশাদারি সংস্থা। ফলে দায়িত্বরত পুলিশের সামান্যতম ভুলভ্রান্তি সহজেই মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। পুলিশের যেকোনো শৃঙ্খলাপরিপন্থী আচরণের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানপূর্বক যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় প্রয়োজনে ফৌজদারি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তাই সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা না করে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন দেশের একটি বৃহৎ সেবাপ্রদানকারী ও প্রধান তদন্তকারী সংস্থার বাস্তব অবস্থার পূর্ণ প্রতিফলন হতে পারে না।
সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করে তারা বলছে, টিআইবি প্রকাশিত জরিপের গবেষণা প্রতিবেদন সত্যিকার অর্থে স্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর নয়। গবেষণা প্রতিবেদনে শাব্দিক ব্যবহার পর্যালোচনা করলে বিষয়টি সহজেই প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণত সার্বিকভাবে কোনো একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং কোনো ব্যক্তিবিশেষ দুর্নীতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের দুর্নীতি বা অপকর্মের দায় কোনোভাবেই সমগ্র প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায় না। তদুপরি, পুলিশ ইন্টারনাল ওভারসাইট সব সময় পুলিশের অপেশাদার ও অনৈতিক কার্যক্রমের ওপর তদারকি অব্যাহত রাখে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর থাকে। সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দেওয়া সমীচীন নয়।

Check Also

সাতক্ষীরায় পুত্রবধূর হাতে নির্যাতিত সেই স্কুলশিক্ষক মারা গেছেন

ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরা:   ছেলে ও পুত্রবধূর হাতে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের শিকার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশতলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।