রয়টার্স, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস : রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের দায়ে মিয়ানমারের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিসভায় উত্থাপিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান ও বিরোধী ডেমোক্রেট সদস্যরা মিলে গত শুক্রবার যৌথভাবে ওই প্রস্তাব এনেছেন। প্রস্তাবটিতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল অং মিন হ্লাইংসহ সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ সদস্যদের ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা হয়ে থাকতে পারে ধরে নিয়েই এর বিচারে যুক্তরাষ্ট্রকে তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা পুরোপুরি কাজে লাগাতে প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর আগে গত ১৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তর রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের সঙ্গে সম্পৃক্ত মিয়ানমারের চার জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা ও দুটি সামরিক ইউনিটের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ভবিষ্যতে আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের ‘টেররিজম অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের’ আন্ডার সেক্রেটারি সিগাল মেন্ডেলকার। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিনিধিসভায় উত্থাপিত প্রস্তাবে রোহিঙ্গা ‘গণহত্যার’ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে কি না তা জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিসভায় নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাবটি এনেছেন সভার সদস্য স্টিভ শ্যাবোট, ইলিয়ট ইঙ্গেল, এড রয়েস, অ্যাডাম শিফ, থিওডোর স্কট ইয়োহো, ব্র্যাড শারমেন, বারবারা জিন কমস্টক ও জোসেফ ক্রাউলি। প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গত শুক্রবারই প্রতিনিধিসভার পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিনিধিসভার সদস্য স্টিভ শ্যাবোট বলেছেন, গত বছর রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনী যে ধরনের অপরাধ করেছে এবং দেশটির বেসামরিক সরকার ত্রুটিপূর্ণ যে বিচারের মাধ্যমে রয়টার্সের সাংবাদিক ওয়া লোন ও কিয়াও সোয়ে ওকে কারাদণ্ড দিয়েছে তাতে তিনি শঙ্কিত না হয়ে পারেন না।
প্রতিনিধিসভার সদস্য ইলিয়ট ইঙ্গেল বলেন, রয়টার্সের দুই সাংবাদিক যেসব বিষয়ের খবর দিচ্ছিলেন সেগুলোকে আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে জানি এবং সেগুলোতে গণহত্যার সব আলামত আছে। বিশ্বাসযোগ্য ও উপযুক্ত আন্তর্জাতিক আদালতে অনতিবিলম্বে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নেতাদের বিচার হওয়া উচিত।
এড রয়েস বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর সহিংসতায় লিপ্ত আছে। তারা গণহত্যা চালাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের প্রতিনিধিসভায় উত্থাপিত প্রস্তাবটিতে মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘের স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদন, সুপারিশসহ সাম্প্রতিক সব ঘটনা আমলে নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবের ১১টি দফার শুরুতেই মিয়ানমারে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে। প্রস্তাবটিতে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে মিয়ানমারের নৃশংসতাকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’, ‘গণহত্যা’ বা অন্যান্য অপরাধ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেবে কি দেবে না তা নির্ধারণ করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের অপরাধগুলোর তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সরবরাহ করার ক্ষেত্রেও পূর্ণ সহায়তা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান রয়েছে প্রস্তাবে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার নীতির সঙ্গে সংগতি রেখে আইন পরিবর্তন এবং রোহিঙ্গাদের অনতিবিলম্বে ফেরার সুযোগ দিতেও আহ্বান জানানো হয়েছে প্রস্তাবে। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের জন্য যথার্থ আন্তর্জাতিক কাঠামো সৃষ্টির জন্য কাজ করতে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া রয়টার্সের দুই সাংবাদিকসহ অন্যান্য সাংবাদিক ও রাজবন্দির মুক্তি দিতে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
এক সময়ে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের প্রতীক অং সান সু চি এখন হয়ে পড়ছেন সমাজচ্যুত। অথচ স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে তিনি দেশটির পার্লামেন্ট এবং দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নামও নিয়েছেন তিনি।
কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কটে ভূমিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছেন তিনি। তিনি অনেকটাই রক্ষণশীলতা এবং কর্তৃত্বমূলক নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এখন মিয়ানমারেও তিনি এক হতাশার নাম।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী-পন্থি এক কলামনিস্ট এনগার মিন সোয়ে সু চি ঘুষ নিচ্ছেন এবং দেশে বিভেদ সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন। ফেসবুকে দেয়া পোস্টে তিনি লিখেন, ‘তিনি একজন ক্ষমতা-পাগল পতিতা।’ এরপর পুলিশ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মিন সোয়েকে গ্রেফতার করে। এ মাসে আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছরের কারাদণ্ড ও দেয়।
মিয়ানমারে বাক স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার এক আইনজীবী মাউং সাউংখা বলেন, ‘সরকার এভাবে দেশ পরিচালনা করতে থাকলে আমাদের দেশে কখনোই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে না এবং আমরা আবারো একনায়কতন্ত্রে ফিরে যাব।’
মিয়ানমারে সামরিক শাসনামলে সরকারের সমালোচনা করায় মাউং সাউংখাকেও ছয় মাসের কারাদ- ভোগ করতে হয়েছিল।
সম্প্রতি ব্রাসেলসভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) সু চির সমালোচনা করে বলেছে, একজন নোবেলজয়ীর অধীনে রাজনৈতিক পটভূমি বদলের বিশেষ আন্তর্জাতিক খবর থেকে মিয়ানমার এখন হতাশার বিপজ্জনক উপাখ্যান হয়ে উঠেছে।