সাতক্ষীরায় কর্মক্ষেত্রে ৪ লাখ নারী শ্রম বৈষ্যমের শিকার: দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা দরকার দাবী জেলা প্রশাসকের

আবু সাইদ বিশ্বাসঃ  ক্রাইমবার্তা রিপোট: সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরায় কর্মক্ষেত্রে নারীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষির পাশাপাশি, হস্ত শিল্প, কারিগর, নির্মাণ ও গ্রামীন উন্নয়নে পুরুষের সমান তালে কাজ করছে নারীরা। দিন দিন উপকুলীয় এ জেলাটিতে কৃষিতে পুরুষের চাইতে নারী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। তালনা মূলক নারী শ্রমিকের পারিশ্রমিক কম থাকায় মাহজনরা নারী শ্রমিকের শ্রম নিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে। এতে উৎপাদন খরচ হ্রাস পাচ্ছে। নারীদের অভিযোগ পুরুষের সমান কাজ করলেও তারা মজুরি বৈষ্যম্যের শিকার। তারা পুরুষের তুলনায় অর্ধেক মজুরি পান। যদিও জেলাতে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর মতে ২০১১ সালের জরিপে সাতক্ষীরা জেলা মোট জনসংখ্যা ছিল ১৯ লক্ষ ৮৫ হাজার ৯৫৯ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ১০ লক্ষ ৩ হাজার ১৮২ জন এবং পুরুষের সংখ্যা ৯ লক্ষ ৮২ হাজার ৭৭৭ জন। জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে বর্তমানে জেলাতে পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা ২৩ লাখের কাছা কাছি। পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। জেলাতে প্রায় ৪ লক্ষ নারী বছরের বিভিন্ন সময়ে শ্রম বিক্রি করেন। আর দুই লক্ষ নারী সারা বছরই শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। প্রায় ৪ লক্ষাধীক নারী স্বামীর গৃহে কাজ করেন। ২ লক্ষাধীক নারী লেখাপড়ার কাজে কর্মরত। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে এমন চিত্র উঠে এসেছে জেলাটিতে।
কয়েক জন নারীর সাথে কথা হয়। তারা জানান, সমাজে নারী হল-অবহেলা, বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার ভাগ্য বিড়ম্বিত এক জীবন। যে জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই সমাধান।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ শ্রমশক্তি বিষয়ক এক জরিপ বলছে, কৃষি অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান ৬৪.৪ শতাংশ এবং পুরুষর অবদান ৫২.৮ শতাংশ। বিবিএসের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক

দশকের ব্যবধানে দেশের কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০২ শতাংশ। সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে ২ শতাংশ। ২০০০ সালে দেশের কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৫ লাখে। বর্তমানে তা প্রায় দেড় কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
প্রতিবেদন বলছে, ১০ বছরের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ নারী কৃষিতে যুক্ত হয়েছেন। কৃষির বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রমবিভাজনের কারণে নারী শ্রমিকের চাহিদা বেড়েছে। বেশিরভাগ পুরুষ পেশা পরিবর্তন করে অ-কৃষিকাজে নিয়োজিত হচ্ছেন, কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন ।
জেলায় ,আমন, ইরি ও চলতি আউশ মৌসুমে মাঠের পাকা ধান কাটতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা চোখে পড়ার মত। অনেক ক্ষেতে পুরুষ মহিলা সমান সংখ্য আর অনেক ক্ষেতে পুরুষের চাইতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি।
নিম্ন আয়ের পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন কাটিয়ে উঠতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজে যোগ দেন। সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, শুধু ধান কাটা নয়, ধানের চারা রোপণ, ধান শুকানো, ধান মাড়াই, সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে সম্পৃক্ত এখানকার নারী। পুরুষের অনুপস্থিতিতে নারী প্রধান পরিবারের ব্যক্তি নারী প্রধানত কৃষি কাজের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। শুধু উৎপাদন নয়, একাধারে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত নারীরা। খাঁটুনি বেশি, কাজে ফাঁকির সুযোগ নেই, আবার কাজের সময়সীমাও বেশি- অথচ মজুরি কম। কৃষিতে নারীর অবদানের কোন স্বীকৃতিও এখনো নেই।
তালার ফসলের মাঠে নারী কৃষকের দেখা মেলে। অন্যান্য স্থানে সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালন, মৎস্য খামার পরিচালনা, হাঁস-মুরগি পালন, ফসলের ক্ষেত নিড়ানি, মাঠের ফসল ঘরে তোলা ইত্যাদি কাজে অসংখ্য নারীকে দেখা যায়। নারী কৃষক গোপী রাণী বলেন, পুরুষের চেয়ে আমরা বেশি কাজ করি। কাজে ফাঁকি দেই না। বিড়ি-সিগারেট টানতে আমাদের সময় অপচয় হয় না। সময় ধরে কাজে আসতে হয়, যেতে হয়। তবুও আমাদের মজুরি কম। মালিক বলে, আমরা নারী, আমরা পুরুষের মত কাজ পারি না।
ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, জেলার কোন কোন এলাকায় শতকরা ৫০ শতাংশ নারী ঘরের বাইরের কাজে নিয়োজিত। কৃষি মাঠে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আকাশী দাস কিছুটা ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, কাজের মৌসুমে বাড়তি মজুরি পাওয়ার আশায় এই এলাকার পুরুষেরা নড়াইল,ফরিদপুর, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজে যায়। ফলে এলাকায় পুরুষ কৃষি মজুরের সংখ্যা কমে যায়। তখন ভূমি মালিকেরা মাঠের কাজে টানেন নারীদের। আবার সংসারের অভাব ঠেকাতে নারীরাও সেই ডাকে সাড়া দিয়ে কাজে নামেন। এভাবেই জেলায় নারী কৃষকের সংখ্যা বেড়ে যায়।
অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিকায় এক গবেষণাসূত্র বলছে, বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ গ্রামীণ নারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে জড়িত।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্রামীন ৪১ শতাংশ নারী চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত। কৃষি তথ্য মতে ফসল উৎপাদনের ২১টি ধাপের ১৭টিতেই নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ রয়েছে।
জেলার ধানের চাতালে কর্মরত শ্রমিকের ৯০ ভাগই নারী শ্রমিক।
জাহানার বেগম একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সে জানালেন প্রতিদিন সকালে পুরষ সদস্যদের অন্তত একঘণ্টা আগে কাজে যোগ দেন তারা। দিনশেষে আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টা পরে কর্মস্থল ত্যাগ করতে হয়। এরপরেও তাদের সবাইকে মজুরি বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এমনকি অনেক ঠিকাদার নারী বলে তাদের কাজেও নিতে চান না। কাজের ধরন ও সময় অনুসারে মুজরি নির্ধারণ করা হলেও নারীরা প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেক কিংবা তার চেয়েও কম মজুরি পান। একজন পুরুষ শ্রমিক দৈনিক দুই বেলায় ৫০০ টাকা মজুরি পেলেও একজন নারী শ্রমিক পান ৩০০ টাকা।
খলিষখালির মঙ্গলানন্দকাটী গ্রামের মোতালেব শেখের স্ত্রী খাদিজা সংসারের পাশা পাশি কয়েক বছর ধরে নারী শ্রমিক হিসেবে কৃষিতে শ্রম দেন। এতে প্রতি দিন দেড় থেকে দুইশত টাকা উপার্জন হয় তার। কিস্তু সব সময় কাজ না হওয়াতে তার সংসার চলতোনা। ছেলে মেয়ের পড়া লেখার খরচ মেটানো কষ্টকর হয়ে পড়ত। বাধ্য হয়ে সাতক্ষীরা টিটিসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে বিদেশ যায়। বর্তমাসে সে ২০ হাজার করে টাকা দেশে পাঠাতে পারে। তিনি জানান, দেশে কত কষ্ট করেও টাকা আয় করতে পারতান না এখন অনেক ভাল আছি। সে চলতি মাসে ১০ কাঠা কৃষি জমি বন্ধ রাভবে। যাতে তার স্বামী কাজ কাম করতে পারে। 
কৃষি নালীদের দাবী জাতীয় কৃষি নীতিমালায় নারী কৃষকের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা সংযুক্ত করে ‘কৃষক’ হিসেবে নারীদের কৃষি উপকরণ সেবা প্রাপ্তিতে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে। তাদের কাছে কৃষি সংক্রান্তসব তথ্য পৌঁছাতে হবে। প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থায় গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে যথাযথ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এখ্যাতে সংশ্লিষ্টরা বলছে, নারীদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি অনেক খানিক চাঙ্গা হবে।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন জানান, সরকারের গৃহীত নানা মুখি বাস্তব পদক্ষপের কারণে নারী বৈষম্য অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। জেলা মহিলা অধিদপ্তর, সমাজ সেবা, যুবউন্নয়ন, বিনেপোতা টিটিসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন এনজিও নারীদের অধীকার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। নারীদের শিক্ষিত করতে সরকার ডিগ্রী পর্যন্ত বিনামূল্যে পড়া লেখা নিশ্চিত করেছে। বিশেষ করে নারী বৈষম্য কমাতে সকলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা দরকার। বাল্য বিবাহ বন্ধ হলে নারী নির্যতন হ্রাস পাবে। এজন্য সকলের সহযোগীতা দরকার। আর নারীদের কাজকে খাটো করে না দেখে তাদের মূল্যায়ন করা দরকার আমাদের সকলের। —

Check Also

সাতক্ষীরায় পুত্রবধূর হাতে নির্যাতিত সেই স্কুলশিক্ষক মারা গেছেন

ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরা:   ছেলে ও পুত্রবধূর হাতে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের শিকার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশতলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।