সাতক্ষীরায় আ’লীগের দ্বন্ধ প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে

সুভাষ চৌধুরী
আগে থেকেই নিজ দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিভাজন বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কথায় বার্তায় আচরণে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তার আলামত মিলছিল। এ নিয়ে কথা বার্তা আলোচনা সমালোচনা কম হয়নি। রাজধানী ঢাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে এসব নিয়ে বসাবসি হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের সাথে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর সাতক্ষীরায় সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে হাতে হাত উঁচিয়ে শপথ করিয়েছিলেন। এর আগে তিনি একই মঞ্চে একজন জনপ্রতিনিধিকে ভৎসনাও করেছিলেন। কোনো লাভই হয়নি। সেতু মন্ত্রী বলেছিলেন রাস্তায় গাছে পোস্টার ব্যানার টানিয়ে শত শত মোটরসাইকেল নিয়ে শোভাযাত্রা শো ডাউন করেও মনোনয়ন পাওয়া যাবে না। তবে দলে বিভেদ সৃষ্টি করবেন না। করলে কিন্তু শেষ রক্ষা হবে না। এতেও নেতারা এতোটুকু সংশোধিত হননি। বরং চুটিয়ে দ্বন্দ্ব বিভেদ টিকিয়ে রেখেছেন। তারা মুখ দেখাদেখি বন্ধ করেছেন। এক মঞ্চে উঠতে পারছেন না।
আর এই দ্বন্দ্ব বিভেদের আবারও বহি:প্রকাশ ঘটলো সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের এক আনন্দঘন অরাজনৈতিক অনুষ্ঠানে। এ ঘটনা বহুজনের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এখানে রাজনীতির দ্বন্দ্ব দেখানোর সুযোগ নেই। এখানে কথা বলে নিজের প্রচার দিয়ে মনোনয়ন পাবারও সুযোগ নেই। তবে এখানে কথা বলে সমাজকে সচেতন করা যায়। নিজের রাজনৈতিক বাসনার কথা ফুটিয়ে তোলা যায়। সরকারি দল ও বিরোধী দল এমনকি নিজের কর্মকান্ডের ফিরিস্তিও তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বিষ্ময়ের সাথে বলতেই হবে প্রেসক্লাবে সেদিন যা ঘটেছিল তা রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্জিত। এতে নিজেকে অনেক বেশি বড় ভাবা হয়েছে। নিজেকে শিক্ষক আর অন্যদের প্রতি অবুঝ ছাত্রসম তুলনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই আচরণ রাজনীতির সাথে যায়না। রাজনীতি ও দলীয় আদর্শের সাথে তা মানায় না।
খবরে প্রকাশ গত বৃহস্পতিবার দুর্গাপূজার মহানবমী তিথিতে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব আয়োজন করেছিল ‘দুর্গোৎসব ও বাংলাদেশ, সম্প্রীতির সেতু বন্ধন’ অনুষ্ঠানের। এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে জেলার শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়াও সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক নেতা এবং বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শুরুর মূহুর্তে আরেকজন সম্মানিত জনপ্রতিনিধির আগমনে বিগড়ে যান অপরজন। গরম কড়াইয়ে হঠাৎ তেল ঢেলে দেওয়ার মতো তেতিয়ে ওঠেন তিনি। ক্রোধান্বিত হয়ে অনুষ্ঠানে এতোটুকু সময় দিতে পারবেন না বলে প্রটোকল ভেঙ্গে উপস্থাপকের কাছ থেকে মাইক্রোফোনটি নিয়ে নেন তিনি। সবার আগে কথা বলেন ইংরেজী বাংলার সংমিশ্রন ঘটিয়ে। বলেন, আমরা মুখে বলি এক রকম। কাজ করি আরেক রকম। যা বলি তা করিনা। যা করি তা বলিনা। আমাদের কারও কারও ভেতরের চেহারা এক রকম। বাইরের চেহারা আরেক রকম। এ সমস্ত লোক কোনো জায়গায় থাকলে আমি সেখানে থাকিনা। আমাকে যেভাবে দু’বার ফোন করা হয়েছে তাতে আমার বাপও কবর থেকে উঠে আসতে বাধ্য। তাই এসেছি। আগে জানলে আসতাম না। কথা বলার পরিবেশ নেই এখানে। ‘আই ডোন্ট লাইক দিস। আই অ্যাম বিজি নাউ’। তবে তিনি বললেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছি। ততক্ষণে ক্রোধে যেনো আরও লাল হয়ে উঠলেন তিনি। অবশেষে অতিথি মঞ্চ আয়োজক কর্তৃপক্ষ ও দর্শক সারির আমন্ত্রিত অতিথিদের হতাশ করে মঞ্চ ছেড়ে গেলেন জনপ্রতিনিধি।
প্রেসক্লাবে অভ্যাগত অতিথিবর্গ রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ বিপুল সংখ্যক সংবাদকর্মী কেউই কিন্তু এতে সন্তোষ প্রকাশ করেন নি। বরং চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন ‘জনপ্রতিনিধি যা করলেন তা তার জন্য রাজনৈতিক বুমেরাং। তিনি কথা বলবেন প্রাসঙ্গিক বিষয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ নিয়ে। অথচ তার ধারে কাছেই যাননি তিনি। তিনি পরোক্ষভাবে আক্রমন করেছেন তার দলীয় নেতাদের। আর এজন্য প্রতিবাদ ওঠে প্রেসক্লাব হাউস থেকেই। তারা স্পষ্ট অস্পষ্ট স্বরে নানা বাক্য ছুড়ে দেন তার প্রতি। নানাভাবে সমালোচনার শিকার হন তিনি। কেউ বলেন, এটা এক ধরনের রাজনৈতিক স্খলন। ত্রিশংকু অবস্থা। তাই আবোল তাবোল বকতে শুরু করেছেন। অনেকে বলেছেন, এমন সিন তিনি আগেও বহুবার ক্রিয়েট করেছেন। সম্মানিত ব্যক্তিকে যথার্থ সম্মান না দেওয়ার সংস্কৃতি বেশ রপ্ত করেছেন তিনি। সমাজের শিক্ষিত অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের অনুষ্ঠানেও বিনা কারণে বেমানানভাবে অহেতুক ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করে তিনি ইংরেজী জানা না জানা সব মানুষের কাছে উটকো সমালোচনা ও বিরক্তির খোরাক হয়ে পড়েছেন। তারা বলেছেন, রাজনীতিতে অহংকারের স্থান নেই। এখানে আছে মানুষকে ভালবাসার সুযোগ। সরকারের উন্নয়ন ভাবনা তুলে ধরার সুযোগ। সরকারের কর্ম পরিকল্পনা প্রচারের সুযোগ। সমাজের ভালো ও মন্দ চিত্র তুলে ধরারও সুযোগ। সন্ত্রাস সাম্প্রদায়িকতা জঙ্গিবাদ অনিয়ম বিশৃংখলা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির সুযোগ। আছে সব ধরনের মানুষের সাথে সেতু বন্ধন গড়ে তোলারও সুযোগ। কিন্তু জনপ্রতিনিধি সেই সুযোগ নিজেই হারিয়ে ফেললেন। রাজনৈতিক দলে যেমন বিরোধ থাকতেই পারে, তেমনি এর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারও থাকতে পারে। তাই বলে তার বহি:প্রকাশ ঘটানো হবে প্রেসক্লাবের অরাজনৈতিক অনুষ্ঠানে এটা কেউ মানতে রাজী নন।
আসলে সমাজ দুর্নীতির বাতাসে দূষিত হয়ে পড়ছে। দুর্নীতি ঢাকতে নানা অপকৌশলের প্রয়োগ রয়েছে। উন্নয়ন ব্যর্থতা ও দুর্নীতির এই কলুষিত চিত্র ঢাকতেই কী দলীয় নেতাদের এক হাত দেখে নেওয়ার উদ্দেশ্যে এমন আক্রমন? এই প্রশ্ন তো এখন সামনে উঠে এসেছে। সংসদ নির্বাচন সামনে। নিজের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতেই কী অপছন্দের রাজনীতিককে অপমানজনকভাবে এই আক্রমন। এটা নিয়ে শহর জুড়ে এখন তোলপাড়। নিশ্চয়ই এই উটকো সমালোচনা কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়। না সমালোচক, না সমালোচিতের।
পাদটীকা
একজন লোক আছে বাস সাতক্ষীরাতে
বলে খুব সুখ আছে এইখানে থাকাতে
যা কিছু বলা যায় যা খুশী করা যায়
সবকিছু বলেও বেশ হজম করা যায়
রবির আলো তো মিশে যায় জোছনায়
আঁধার মিলে যায় ওই দুর সীমানায়
সামনে ভোটাভুটি হেসে তাই কুটি কুটি
ইংরেজী বুঝতে ডিকশনারি ঘাটাঘাটি
অধম মানুষ মোরা কোথা যাই বল হে
তার চেয়ে চলো যাই বনে সুখ খুঁজি হে।
লেখক: সাংবাদিক, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।