একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অনেকের প্রশ্ন-২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপি এখন কী করবে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থাকার পাশাপাশি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনও চালিয়ে যাবে বিএনপি।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, ক্ষমতাসীন দল যেনতেন একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারো ক্ষমতায় আসতে চায়, সেটি তারা নিশ্চিত। তবে এবার খালি মাঠে গোল দিতে দেয়া হবে না। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থেকেই সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, সংসদ ভেঙে দেয়া ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিসহ ৭ দফা দাবিতে যে আন্দোলন কর্মসূচি চলছে, তা অব্যাহত থাকবে। বিভাগীয় পর্যায়ে ঐক্যফ্রন্ট আরো বেশ কয়েকটি সমাবেশ করবে। একই সাথে সম্পন্ন করা হবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া। বিএনপি ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর সাথে সমন্বয় করে আসন ভাগাভাগি করবে। প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেয়ার তারিখ পার হওয়ার পর বিএনপি আন্দোলন কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনতে পারে। সিনিয়র এক নেতা বলেছেন, তখন পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায় তা এখনি বলা মুশকিল।
দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার নাইকো মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার পর সেখানে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় তাকে এ নির্দেশ দেন বেগম জিয়া।
জানা গেছে, বিএনপি মহাসচিব বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং সংলাপের বিভিন্ন বিষয় দলীয় প্রধানকে অবহিত করেন।
আদালত থেকে মির্জা ফখরুল সরাসরি নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন। সেখানে কয়েকজন নেতার সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। সেই সূত্র ধরে এ তথ্য জানা গেছে।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, আন্দোলনে গেলেও আলোচনার পথ বন্ধ না করার পক্ষে দলটি। বেগম খালেদা জিয়ার এক মামলায় সাজা দ্বিগুণ করা, আরেক মামলায় সাত বছরের সাজা দেয়া নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অব্যাহত থাকলেও, নির্বাচন বর্জন করার মতো কোনো চিন্তা এখন পর্যন্ত বিএনপি বা তার জোটের নেই। এ ক্ষেত্রে আন্দোলনের ধরন ও দিনক্ষণ ঠিক করতে আলোচনা চলছে।
নির্বাচন ও আন্দোলনের বিষয়ে গত বুধবার দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা ও সম্পাদকদের পরামর্শ নিয়েছে বিএনপি। সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা ছাড়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া ঠিক হবে না বলে তারা হাইকমান্ডকে জানিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে দাবি আদায়ে আন্দোলনের বিকল্প নেই বলেও মত দেন তারা। নেতারা বলেছেন, মামলা-হামলার কারণে নেতারা নিজ এলাকায় যেতে পারছেন না, কার্যালয়ে বসতে পারছেন না। অথচ মতাসীন দলের নেতারা প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। এ অবস্থায় নির্বাচনে যাওয়া হবে ‘আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্ত। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে গেলে তৃণমূল গ্রহণ করবে না বলে আশঙ্কার কথা দলের নীতিনির্ধারকদের জানান কেন্দ্রীয় নেতারা।
বিএনপির অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা এলাকাছাড়া। তাদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা। জেলখানায় খালি জায়গা নেই। দলীয় কার্যালয়ে কেউ বসতে পারেন না। যেখানে মতাসীন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন, সেখানে বিএনপি নেতারা তাদের কার্যালয়েই বসতে পারছেন না। ম্যাডাম খালেদা জিয়া জেলখানায়। এ অবস্থায় নির্বাচনে যেতে হলে, আগে সুষ্ঠু পরিবেশ আদায় করতে হবে।
মামলা আর গ্রেফতারে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা এখন একদমই কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে তাদের মাঝে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই। মাঠেই নামতে পারছেন না কেউ। এক দিকে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে, অন্য দিকে গত ৭২ ঘণ্টায় প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি।
বরিশাল-১ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী আ ক ন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা এখন কর্মী শূন্য। পুলিশ বিএনপির তৃণমূল কমিটির তালিকা ধরে ধরে মামলা দিচ্ছে, গ্রেফতার করছে। আসলে সরকার চায় না একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। তারা ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনেরই নীলনকশা আঁটছে।
ফরিদপুর-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী মাহবুবুল হাসান পিঙ্কু বলেন, মামলা-হামলা-গ্রেফতার যেভাবে চলছে, তাতে কিসের নির্বাচন। আমরা ঘরে থাকতে পারছি না। পুলিশ ওঁৎ পেতে আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করেই নির্বাচনে যেতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী মাহমুদুর রহমান সুমন বলেন, নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। সরকারি দলই একতরফাভাবে মাঠে আছে। আমার এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরাই শুধু নয়, সমর্থকরা পর্যন্ত আতঙ্কে রয়েছে। পুলিশ তালিকা করে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, অন্য দিকে পুলিশ প্রশাসন দিয়ে নির্বাচনী মাঠ দখলে রাখা হয়েছে।
বাগেরহাট-৩ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ধানের শীষের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত। কিন্তু সেই পরিবেশই তো নেই। প্রতিদিন মামলা হচ্ছে। আমরা মাঠে নামলেই পুলিশ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে, হামলা চালিয়ে ভণ্ডুল করে দিচ্ছে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠক : এ দিকে তফসিল ঘোষণা হওয়ার পর বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৈঠক করেছেন। বৈঠকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় থাকার পে মত দিয়েছেন অনেক নেতা। পাশাপাশি আরো কয়েক দিন পরিস্থিতি পর্যবেণ করার মতও এসেছে।
গত রাতে গুলশান কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির এই বৈঠক বসে। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে নেতারা তাদের মত তুলে ধরেন। কেউ কেউ সিদ্ধান্তের ভার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের ওপর ছেড়ে দেন।
বৈঠক শেষে এক নেতা জানান, তারা নির্বাচনে যাওয়ার পে থাকলেও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে কারাগারে পাঠানোসহ কয়েকটি ঘটনা পর্যবেণ করছেন। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
বৈঠকে মির্জা ফখরুল ছাড়াও ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান ও নজরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।