ক্রাইমবার্তা রিপোর্টঃ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫০ টি আসনের মধ্যে ৪৭ টি আসনেই গুরুতর অনিয়ম পাওয়া গেছে বলে টিআইবির গবেষণায় উঠে এসেছে।
আর এই সব অনিয়ম ঠেকাতে নির্বাচন কমিশন যথাযথ ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়নি বলে টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়।
মঙ্গলবার সকালে ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারের নিজস্ব কার্যালয়ে ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশের সংবাদ সম্মেলনে এসব মতামত ব্যক্ত করে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
টিআইবি এবারের নির্বাচনে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে ৪৫টি জেলার ৫০টি আসনের নির্বাচন বিষয়ে গবেষণা করে। তারই আলোকে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।
নির্বাচনের দিন সারা দেশের ২৪ জেলায় নির্বাচনী সহিংসতায় ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং ২০০ জন আহত হয়।
৫০ টি আসনের মধ্যে ৪৭ টি আসনেই বিভিন্ন অনিয়ম পায় টিআইবি। অনিয়মের ধরনের মধ্যে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে রাখা, আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট দেওয়া, ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট পেপার ভর্তি বাক্স, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, এবং প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া।
এসব অভিযোগ সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য অনুযায়ী “কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি ভালো”। অন্যদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’ ছিল।
এছাড়া বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী ‘পর্যবেক্ষক’রা নির্বাচন “অংশগ্রহণমূলক” হয়েছে বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও গণ-মাধ্যমে নির্বাচনে অনিয়মের সমালোচনা করা হয়েছে বলে বলা হয়েছে গবেষণায়।
টিআইবির গবেষণায় উঠে এসেছে যে সারাদেশে বেশিরভাগ কেন্দ্র আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের নেতা-কর্মীদের দখলে ছিল। অন্যদিকে বেশিরভাগ কেন্দ্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট ছিল না, অথবা সকালে তাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে ৭৬ জন প্রার্থী নির্বাচন চলাকালীন ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন বলেও প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় বলা হয়েছে।
এছাড়া গবেষণার অর্ন্তভুক্ত ৫০ টি আসনের মধ্যে ১৩টি আসনে ভোট ৯০ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েছে। অন্যদিকে ৫০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে মাত্র তিনটি আসনে।
নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত আসনগুলোতে আওয়ামী লীগ ৪০, জাতীয় পার্টি ৬, বিএনপি ১, গণ ফোরাম ২, অন্যান্য দল একটি আসনে জয়ী হয়েছে।
জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ২৫৭, জাতীয় পার্টি ২২, বিএনপি ৫, গণ ফোরাম ২,স্বতন্ত্র ৩, অন্যান্য দল ৯ আসনে জয়ী হয়। তবে দেখা যায় ১৮৬টি আসনে ভোট দেওয়া হয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি – এর মধ্যে
এছাড়া গবেষণার অন্তর্ভুক্ত আসনগুলোতে জয়ী প্রার্থীরা গড়ে ১ কোটি ২৭ লাখ ৩৩ হাজার ৮৭৭ টাকা ব্যয় করেছেন। এর মধ্যে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ৪ কোটি ৫৫ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয় করেছেন বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে।
নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোট, যাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, সিপিবি, খেলাফত মজলিস, বাসদ, গণ সংহতি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন কমিশনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট স্মারকলিপি প্রদান করে ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ নেয়নি। সব দলের সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল না। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনে সরকারের ভূমিকার প্রেক্ষিতে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নীরবতা পালন করেছে বা ক্ষেত্রবিশেষে অস্বীকার করেছে।
এছাড়া নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর প্রচারণার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে নি, এবং একইসাথে সব দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা সমানভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি বলে বলা হয়েছে গবেষণায়।
নির্বাচনী অনিয়ম ও আচরণ বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিশেষকরে সরকারি দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণও তৈরি করতে পারে নি। এর ফলে নির্বাচন কমিশন যেমন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করতে পারে নি, আবার অন্যদিকে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ আছে কি না তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ পেয়েছে, যা নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার ঘাটতি তৈরি করেছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও সংবাদ-মাধ্যমের জন্য বেশ কয়েকটি নিষেধাজ্ঞার কারণে কমিশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল কঠোর। নির্বাচনের সময়ে ইন্টারনেটের গতি হ্রাস করা হয়, এবং মোবাইল ফোনের জন্য ফোর-জি ও থ্রি-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা হয়। এছাড়া জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোটরচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নির্বাচনের সময়ে এ ধরনের তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দল/ জোটের কোনো কোনো কার্যক্রম নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে বলে দেখা যায়। সংসদ না ভেঙ্গে নির্বাচন করার ফলে সরকারে থাকার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করা ক্ষমতাসীন দল ও জোটের জন্য সহজ হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, এবং নির্বাচনমুখী অনেক প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে যা নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে বলেও গবেষণায় বলা হয়েছে।