আবু সাইদ বিশ্বাসঃ সাতক্ষীরা: সবজি নিয়ে বিপাকে সাতক্ষীরার চাষীরা। ক্রেতা না পেয়ে শত শত মণ শীতকাীলন সবজি চাষীর ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে। সবজি বিক্রি করতে না পেরে অনেকে গরু ছাগলের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় চলতি মৌসুমে জেলাতে কয়েক কোটি টাকার সবজি নষ্ট হবে জানান চাষীরা। ফলে ন্যার্য দাম না পেয়ে চাষীরা সবজি চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে।
সাতক্ষীরা সুলতানপুর বড়বাজারে পাইকারী ব্যবসায়িরা জানান, বেগুন কেজি প্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা,পাতাকপি ১ থেকে ২টাকা,মিষ্টি কুমড়া ৫ থেকে ৭ টাকা,টমেটো ৬ থেকে ৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মূলা অবিক্রীত থাকছে। চাষীদের দাবী সিন্ডিকেট করে সবজির দাম কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। যেখানে উৎপাদন খরচ কেজি প্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা সেখানে বিক্রি হচ্ছে ৪ থেকে ৫ টাকায়। সবজি চাষীদের দাবী কেজি প্রতি ক্ষতি ৫ থেকে ১ টাকা। পাইকারী ব্যবসায়ীদের দাবী রাজধানী উৎপাদন বেশি থাকায় সবজির চাহিদা কমে গেছে। এছাড়া জেলাতে এত বেশি পরিমানে সবজি উৎপাদন হয়েছে যা কেনার লোক নেই। ফলে দাম অনেক কম। এছাড়া পরিবহন খরচ বেশি হওয়াতে ঢাকাতে সবজি পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
জেলা কৃষিখামার বাড়ি সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে জেলাতে জেলাতে ৯ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভাবে সবজির চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ২ হাজার ৮০ হেক্টও,কলারোয়াতে ১ হাজার ৬শ হেক্টর, তালাতে ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর, দেবহাটাতে ৫৫০ হেক্টর, কালিগঞ্জে ১ হাজার ৯১০ হেক্টর, আশাশুনিতে ৬২০ হেক্টর, এবং শ্যামনগরে ৭শ হেক্জর জমিতে শীতকালিন সবজির আবাদ হয়েছে।
শীতকালিন সবজির মধ্যে বিশেষ করে ফুলকপি ৭৭৫ হেক্টর, বাঁধাকপি ৮০৫ হেক্টর, ওলকপি ৮৩০ হেক্টর, মূলা ৩৮০ হেক্টর, টমেটো ৪৮০ হেক্টর, সীম ৩৯৩ হেক্টর,পালংশাক ৫৭০ হেক্টর, বেগুন ৯৯৬ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবছর জেলাতে সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে।
কৃষি সূত্র জানায়, বিশ্বের মধ্যে সবজী উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। জিডিপিতে বাংলাদেশের কৃষি খাতের অবদান ১৬ শতাংশ। দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ লোক কৃষি খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট। এই কৃষি উৎপাদনশীলতার একটি ক্ষেত্র হচ্ছে সবজি খাত। সবজি উৎপাদনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় এবং সবজির আবাদি জমি বৃদ্ধির দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। যার কারনে প্রত্যেক মৌসুমে সবজির বাম্পার ফলন হচ্ছে। কিন্তু বাম্পার ফলনের কৃষক খুশি নয়। কারন সবজির বাম্পার ফলন হলেও কোনো মৌসুমেই সবজির ন্যায্য দাম পায়না কৃষক। পানির দামে বিক্রি হয় কৃষকের কষ্টার্জিত সবজি। চলতি মৌসুমেও সবজির বাজারে ব্যাপকভাবে ধ্বস নেমেছে। দেশের দৈনিকগুলোর কি
ছু হেডিং প্রত্যক্ষ করলে সবজির বাজারের ধ্বসের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যায়-
জেলার বিভিন্ন হাটে সবজির মধ্যে ফুলকপি ৪/৫ টাকা, সিম ও বেগুন ৫/৬ টাকা, কেজি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। এই দামে সবজি বিক্রি করে হাটে আনতে ভ্যান ভাড়া এবং জমি থেকে ফসল উঠানোর খরচ হচ্ছে না কৃষকদের। বাধাকপি প্রতি পিস ৩/৪ টাকা, গাজর ৭/৮ টাকা কেজি, টমেটো ৮/১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে, কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সবজির ন্যায্য দাম না পেলেও খুচরা বাজারে আবার তিনগুন বেশি দামে সবজি কিনছে ভোক্তাসাধারণ।
এককথায়, দিন-রাত পরিশ্রম করে ক্ষেতে ফলানো সবজি এসব বাজারে এনে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে কৃষকরা। অনেক এলাকায় কৃষক সবজি জমি থেকে বাজার পর্যন্ত আনতে পারে না। মধ্যস্বত্বভোগী পাইকারদের কারণে মাঠেই সবজি বিক্রি করতে হয় নামমাত্র মূল্যে। সেই সবজিই আবার কয়েক দফা হাত বদল হয়ে উচ্চদামে শহরের জনগন কিনছে। অর্থাৎ উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ই শোষিত হচ্ছে।
সাতক্ষীরা পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের মিয়াসাহেবের ডাঙ্গী গ্রামের মোহর আলীর ছেলে ইসমাইল হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে সে এক বিঘা জমিতে ওলকপির চাষ করে। এতে তার খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। কিন্তু বাজারে বর্তমানে যে দাম তাতে তার ওলকপি বিক্রি হবে ৫/৬ হাজার টাকায়। ফলে বিঘা প্রতি তার ক্ষতি ১৪/১৫ হাজার টাকা। একই অভিযোগ জেলার লক্ষাধীক সবজি চাষীর।
সুলতানপুর বড়বাজারের পাইকারী ব্যবসায়ী তেজরাত ভান্ডারের ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম জানান, বাজারে সবজির দাম একে বারেই কম। পরিবহন খরচ বেশি থাকায় ঢাকাতে পর্যাপ্ত সবজি পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় জেলার পাইকারী ও খুচরা বাজারে সবজির দামে তারতম্য বেশি।
জেলার প্রত্যেকটি থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে হিমাগার না থাকায় সবজি সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে কর্তৃপক্ষের দাবী। এখাতে সংশ্লিষ্টরা জানান, কৃষক যদি সবজি সংরক্ষনের উপযুক্ত মাধ্যম পেতো তথা হিমাগার বা সংরক্ষনাগার পেতো তাহলে তারা উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ সবজি হিমাগার রাখতে পারতো। এতে করে সিন্ডিকেট মহল দরপতনের চেষ্টা করলেও কৃষক এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবেনা। সেইসাথে সবজি মৌসুমে পরিপূর্ণ সরবরাহ দিয়ে ন্যায্যমূল্যও পেতে পারবে।
কৃষি বিভাগ জানায় দেশে মোট হিমাগার আছে ৩৪৩টি। এগুলোয় মাত্র প্রায় সাড়ে ২০ লাখ টন পণ্য মজুদ রাখা যায়। এর মধ্যে ১ লাখ ৬২ হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ৪৭টি হিমাগার বন্ধ রয়েছে। চালু রয়েছে ২৯৬টি হিমাগার। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ১৫ হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি হিমাগার রয়েছে। বাস্তবে আরো অনেক হিমাগার থাকা প্রয়োজন হলেও তা নির্মাণ করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত- দেশের প্রায় প্রতিটি থানায়ই সরকারি অর্থায়নে আপাতত কমপক্ষে দুই লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হিমাগার তৈরি করা। দুই লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হিমাগার তৈরি করতে সর্বোচ্চ ৩৫০ কোটি টাকা লাগবে। সে হিসেবে কমপক্ষে ৫০০টি হিমাগার তৈরি করতে সর্বোচ্চ মাত্র ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। ৫০০টি হিমাগারে ১০ কোটি টন খাদ্য সংরক্ষণ সম্ভব। যার ফলে কোনো প্রকার শাক-সবজি নষ্ট হবে না। সেইসাথে কৃষকও শাক-সবজি উৎপাদন করে সেগুলো সংরক্ষণ করে ন্যায্যমুল্য পাবে এবং বাজারেও ন্যায্যমূল্যে জনগণ তা ভোগ করতে পারবে। তবে সাতক্ষীরা জেলাতে সরকারী ভোবে কোন হিমাগার না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চাষীরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অরবিন্দ বিশ্বাস জানান, জেলাতে সবজি সংরক্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারী ভাবে হিমাগার তৈরি জন্য সরকারের যথাযথ র্কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তিনি জানান জেলাতে হিমাগারে তৈরি হলে সবজি নষ্ট হবে না। এছাড়া চাষীরা ন্যার্য় দামও পেতে পারবে।
তিনি আরো জানান, দেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান খুঁজে বের করা হচ্ছে। এজন্য ‘কৃষি (শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) শুমারি-২০১৮’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানায়, এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩৪৫ কোটি টাকা। এর অংশ হিসেবে প্রথম জোনাল অপারেশন কার্যক্রম সমাপ্ত হওয়ার পর চলতি মাসের ৯ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে মাঠ পর্যায়ে দ্বিতীয় জোনাল অপারেশন। এছাড়া আগামী ৬-২০ মে অনুষ্ঠিত হবে মাঠ পর্যায়ের চূড়ান্ত তথ্য সংগ্রহের কাজ।