বেশ অনেকটা আকস্মিকভাবেই জাতীয় সংসদে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি।
হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের সময়সীমা শেষ হওয়ার ঠিক আগেন মুহূর্তে দলটির অবস্থান একেবারে উল্টো দিকে ঘুরেছে বলে নেতাদের অনেকে মনে করছেন।
সোমবার বিকেলে বিএনপি’র নির্বাচিতদের চার জন শপথ নেয়ার পর তাঁরা বলেন যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই তাঁরা শপথ নিয়েছেন।
এর পর রাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একা জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আসেন। তখন তিনি বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের নির্দেশে দলের নির্বাচিতদের শপথ নেয়ার বিষয় নিশ্চিত করেন।
কিন্তু মাত্র এক দিন আগেও বিএনপি শপথ না নেয়ার আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা তুলে ধরেছিল। এমনকি তাদের নির্বাচিতদের কেউ শপথ নিলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করাসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি আদালত পর্যন্ত যাওয়ার হুমকিও দেয়া হয়েছিল দলের পক্ষ থেকে।
গত ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে যারা বিএনপির টিকেটে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে প্রথমে ঠাকুরগাঁ-৩ আসনের জাহিদুর রহমান গত বৃহস্পতিবার যখন শপথ গ্রহণ করেন, তখন খুব দ্রুতই তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল – বস্তুত পরদিনই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
কিন্তু বিএনপি তাদের অবস্থান থেকে হঠাৎ কেন সরে এলো, এই প্রশ্নেই এখন আলোচনা চলছে রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে।
কেন এই অবস্থান বদল?
সংসদে যোগ দেয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সংসদে কথা বলার সীমিত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংসদ ও রাজপথের সংগ্রামকে যুগপৎভাবে চালিয়ে যাওয়াকে তারা যৌক্তিক মনে করেছেন।
তিনি মনে করেন, আজকে যা হবে, কালকে ঠিক তা-ই হবে এমন কোনো কথা নেই, ফলে অবস্থার প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতেই পারে।
তিনি এও বলেছেন যে ‘গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ হিসেবে এবং কৌশলগত কারণে’ তাদের দল এখন নতুন অবস্থান নিয়েছে।
তবে কৌশলগত কারণ সম্পর্কে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির যে বৈঠকে নির্বাচিত এমপিদের শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তাতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে স্কাইপের মাধ্যমে যোগ দিয়েছিলেন
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির অন্য একাধিক সিনিয়র নেতা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে শপথ গ্রহণ নিয়ে তাদের দল ভিন্ন ধরণের একটা সঙ্কটের দিকে এগুচ্ছিল, আর সেজন্যই অনেকটা বাধ্য হয়ে দল অবস্থান বদল করেছে।
তাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, বিএনপি থেকে নির্বাচিত মাত্র ছয় জনের মধ্যে দলটির মহাসচিব মি. আলমগীর ছাড়া পাঁচজনই শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার জন্য নেতৃত্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। তারা এমন শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন যে কোনভাবেই তাদের ঠেকানো সম্ভব ছিল না। ফলে সেখানে নেতৃত্বের ব্যর্থতার প্রশ্ন আসে।
একই সাথে বিএনপির এই সিনিয়র নেতারা বড় বিষয় হিসেবে যা উল্লেখ করেছেন, তাহলো – ছয় জনের পাঁচজনই যখন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদে যেতে পারেন, তখন তাদের দল থেকে বহিষ্কারের পর আইনগত লড়াইয়ে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। কিন্তু তারা বিএনপির সদস্য হিসেবেই সংসদে থাকবেন। সেই প্রেক্ষাপটে তাদের ওপর বিএনপির দলীয় কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
এটিকেই দলটির নেতৃত্ব ভিন্ন ধরণের সঙ্কট হিসেবে দেখেছেন।
ফলে তাদের ঠেকানোর জন্য দলের নেতৃত্বের সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন বিএনপি ওই সদস্যদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করতে চায়নি। আর সেজন্য বিএনপি শেষপর্যন্ত তাদের সদস্যদের সংসদে যাওয়ার বিষয়টিকে অনুমোদন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এছাড়া, বিএনপির সিনিয়র ওই নেতারা আরও জানিয়েছেন যে সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল থেকেও একটা চাপ ছিল।
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি : সমঝোতা হচ্ছে?
আলমগীর যদিও বলেছেন যে তাদের নেত্রীর মুক্তির দাবির সাথে সংসদে যাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই, তবে সংসদে যোগ দেয়া পাঁচজনের মধ্যে হারুনুর রশীদ প্রথম দিনেই অধিবেশনে দেয়া বক্তব্যে তাদের সংসদে অংশ নেয়ার বিনিময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়েছেন।
এই ইস্যুতে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি-না, এমন একটা গুঞ্জনও উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা এই বিষয়ে উদ্ধৃত হতে একেবারেই আগ্রহী নন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র নেতা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে না চাইলে খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়, এটি তারা বিশ্বাস করেন।
কিন্তু কোনো সমঝোতার মাধ্যমে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন, সেটাও তারা দেখাতে চান না – এতে তাদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষতি হবে বলে দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন।
তাদের বক্তব্য হলো, বিএনপি নেত্রী প্যারোলে বা কোনো শর্তে নয়, বরং আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পাবেন, এটি তারা তাদের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের দেখাতে চান। আইনী প্রক্রিয়ার পাশাপাশি তাঁরা এখন সংসদের ভিতরে এবং বাইরে দলের একটা সক্রিয় অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করবেন।
অন্যদিকে, সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে, সোমবার দুপুরে, ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আলমগীর খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে বেশ আবেগপ্রবণ বক্তব্য দেন।
“আমি নিজে দেখেছি তাকে। তিনি এখন বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, তাকে সাহায্য করতে হয়। তিনি হাঁটতে পারেন না, খেতে পারেন না। তার শরীর একদম ভালো নেই” – এমন ছিল বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য।
বিএনপি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিলো?
এই প্রশ্নে দলটিতে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে বলে মনে হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাদের সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে।
তবে দলটির অন্য একাধিক সিনিয়র নেতা মনে করেন, এতদিন শপথ না নেয়ার কঠোর অবস্থান তুলে ধরার পর দল একেবারে উল্টোদিকে ঘুরেছে, যা মাঠ পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটা প্রভাব ফেলবে।
তাদের মতে, পানি অনেক ঘোলা না করে বেশ আগে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল।
আর বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল, যশোর এবং সিলেটসহ কয়েকটি জেলায় দলটির নেতাদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, হঠাৎ দলের এই সিদ্ধান্তে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বেশ অবাক হয়েছেন।
দলে কী প্রভাবফেলবে?
বিএনপির নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন যে সংসদে যোগ দেয়ার বিষয়টি দলের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশের মধ্যে নতুন করে এক ধরণের হতাশা তৈরি করতে পারে বলে তাদের ধারণা।
তারা মনে করেন, দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রতি মাঠ-পর্যায়ের নেতাদের একটা নেতিবাচক মনোভাব দেখা দিতে পারে, যদিও নির্বাচিতরা তাদের নির্বাচনী এলাকার মানুষের চাওয়া বা চাপের বিষয়কে শপথ গ্রহণ করার পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন দলের কাছে।
কিন্তু বিএনপির নির্বাচনী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদল গণফোরামের নির্বাচিত দু’জন সংসদ সদস্য যখন শপথ নিয়েছিলেন, তখন বিএনপি তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তুলেছিল। এ নিয়ে এমনকি জোটে টানাপোড়েনও দেখা দিয়েছিল।
এছাড়া, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বহু বৈঠক হয়েছিল এই ইস্যুতে। সব বৈঠকেই সংসদে না যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলে ওই কমিটির একাধিক সদস্য বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।
বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অনেকের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে যে খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে সংসদে যাওয়ার বিরুদ্ধে তৃণমূলের একটি বড় অংশের অবস্থান ছিল। তাঁরা মনে করেন, হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে মানুষের মধ্যেও তাদের দল ভাবমূর্তির একটা সংকটে পড়বে।
শেষমুহুর্তে যেহেতু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে, ফলে দলে ভিন্নমত থাকলেও এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করার কিছু নেই বলেও মনে করছেন ভিন্নমত পোষণকারী নেতাদের অনেকেই।
তবে এরপরও দলে একটা নেতিবাচক প্রভাব বা চাপা ক্ষোভ থেকে যাবে এবং তা কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লাগবে বলে বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করছেন।
দলের ভিতরের ক্ষোভ কিভাবে সামাল দেবে বিএনপি
বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, সংসদে যারা গেছেন, তাদের এখন অধিবেশনে দলীয় ইস্যুগুলো নিয়ে জোরালো অবস্থান নিতে হবে এবং সেই বার্তাই তাদের দেয়া হয়েছে।
সংসদের বাইরেও দলটি এখন রাজপথের কর্মসূচি অব্যাহত রেখে নেতা-কর্মীদের সক্রিয় করার চেষ্টা চালাবে বলে নেতারা জানিয়েছেন। এভাবে যদি একটা অবস্থান তুলে ধরা যায়, তখন দলের ভিতরে বিতর্ক বা ক্ষোভ – সবকিছুর অবসান হবে বলে নেতৃত্ব মনে করছে।
তবে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব হলে তখন দলে আবার স্থিতিশীল একটা পরিস্থিতি ফিরে আসতে পারে। ফলে এখন সংসদের ভেতরে এবং বাইরে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়কেই একমাত্র ইস্যু হিসেবে নেয়ার চিন্তা দলটির নেতৃত্বের একটা অংশে রয়েছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কবে শপথ নেবেন?
আলমগীর নিজে এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
তবে বিএনপিতে তাঁর ঘনিষ্ট একজন নেতা জানিয়েছেন, নীতিনির্ধারকদের মধ্যে মি. আলমগীর একাই নির্বাচিত হয়েছেন, ফলে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অনেকে তার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারও কারও সাথে তাঁর টানাপোড়েনও সৃষ্টি হয়েছিল।
তিনি বলেন, স্থায়ী কমিটির সব সদস্যই শপথ নেয়ার বিপক্ষে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। ফলে এখন সংসদে যাওয়ায় আলমগীরের সাথে তাদের সেই টানাপোড়েন বাড়তে পারে।
দলটির আরেকজন নেতা বলেছেন, যেহেতু আলমগীর দলের পক্ষে এতদিন কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে আসছিলেন, ফলে এখন তিনিও একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছেন।
তিনি বলেন, দলের স্রোতের বিপরীতে সংসদে গিয়ে যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন হবে, সেটা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়েও তাদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।
ওই নেতা জানিয়েছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব তারেক রহমানের হলেও মি. আলমগীর তাদের দু’একজন নেতাকে জানিয়েছেন যে, বিষয়টাতে তার ব্যক্তিগতভাবেও সিদ্ধান্ত নেয়ার একটা বিষয় আছে।
আর সে কারণেই এখনও স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
সূত্র : বিবিসি