নিউইয়র্ক টাইমসে ইমরান খানের কলাম বিশ্ব কাশ্মীরকে উপেক্ষা করতে পারে না, আমরা সবাই ঝুঁকিতে

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ  গত আগস্টে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর আমার অগ্রাধিকারের একটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী ও ন্যায়সঙ্গত শান্তির জন্য কাজ করা।

বৈরী ইতিহাস সত্ত্বেও ভারত ও পাকিস্তান দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একই ধরনের সংকটের মুখোমুখি। বিশেষ করে আমাদের লাখ লাখ নাগরিকের সামনে পানির আকাল ও হিমবাহ গলে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

কাশ্মীর বিরোধের মীমাংসা ও বাণিজ্যের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেয়েছিলাম আমি। যেহেতু আমাদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে প্রধান অন্তরায় এই কাশ্মীর সংকট।

নির্বাচনে বিজয়ের পর ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই পাকিস্তানে টেলিভিশনে দেয়া আমার প্রথম ভাষণে আমি বলেছি, ভারতের সঙ্গে আমরা শান্তি চাই। যদি তারা এক পা সামনে এগোয়, আমরা বাড়াবো দুই পা।

এরপর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠকের আয়োজন হয়। কিন্তু ভারত তা বাতিল করে দেয়।

ওই সেপ্টেম্বরেই শান্তি ও সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমার তিনটি চিঠির প্রথমটি লিখেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত, শান্তির জন্য আলোচনা শুরুর আমার সবচেষ্টা অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করে ভারত।

প্রাথমিকভাবে আমরা ধরে নিয়েছিলাম, মে মাসে লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে ভারতীয় ভোটারদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী উন্মক্ততা উসকে দিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা ও ক্রমবর্ধমান কট্টরপন্থী অবস্থান নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।

নির্বাচনের মাস কয়েক আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি অধিকৃত কাশ্মীরে স্থানীয় এক তরুণ আত্মঘাতী হামলা চালান। ভারতীয় সরকার দ্রুতই পাকিস্তানের ওপর ওই হামলার দায় চাপায়।

আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণ চাইলে মোদি ভারতীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে পাঠান। আমাদের বিমান বাহিনী একটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করে তাদের এক পাইলটকে আটক করে।

পাল্টা হামলা চালিয়ে এই বার্তা দিলাম যে আমরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম। কিন্তু এমন কোনো লক্ষ্যবস্তুতে হামলার জন্য বাছাই করলাম না, যাতে প্রাণহানি ঘটতে পারে।

দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাতকে পাকিস্তান অবনতির দিকে নিয়ে যেতে চায় না দেখাতেই আমি অত্যন্ত সচেতনভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই আটক ভারতীয় পাইলটকে আমরা ফেরত পাঠিয়েছি।

মোদির পুনর্নির্বাচনের পর ২৩ মে তাকে আমি শুভেচ্ছা জানিয়েছি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা শান্তি, উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করবো বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছি।

পরবর্তী সময়ে জুনে শান্তির জন্য কাজ করতে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে মোদিকে দ্বিতীয় চিঠিটি পাঠিয়েছি। ফের চিঠির জবাব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল ভারত।

এর মধ্যে আমরা দেখতে পেলাম যে যখন আমরা শান্তির প্রস্তাব দিয়েই যাচ্ছি, ভারত তখন আন্তসরকারি অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিষয়ক টাস্কফোর্সে পাকিস্তানকে কালোতালিকাভুক্ত করতে লবিং করে যাচ্ছে। যাতে আমাদের ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও দেউলিয়ার ভেতর ঠেলে দিতে পারে।

একটি পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর শান্তির আকাঙ্ক্ষাকে প্রশমিতকরণ হিসেবে নিয়ে মোদি ভুল করেছেন। আমরা কেবল একটি বৈরী সরকারেরই না, এক ‘নতুন ভারতের’ সম্মুখীন- হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদের ফসল এমন একটি দল ও নেতৃত্বের মাধ্যমে যেটি পরিচালিত হচ্ছে। এবং যেটির রসদ যোগাচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ(আরএসএস)।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দেশটির কয়েকজন মন্ত্রীর আরএসএসের সদস্যপদ বহাল রয়েছে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতারা বেনিটো মুসোলিনি ও অ্যাডলফ হিটলারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন।

আরএসএসের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা এমএস গোলওয়াকারের প্রতি ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে মোদি নিবন্ধ লিখেছেন এবং তাকে পূজনীয় গুরু হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

১৯৩৯ সালের গ্রন্থে ‘চূড়ান্ত সমাধান’ বা ফাইনাল সলিউশন সম্পর্কে মোদির গুরু শ্রদ্ধাভরে লিখেছেন, ‘আমাদের জাতীয়তা আমরা নির্ধারণ করেছি।’

‘জাতিগোষ্ঠী ও তাদের সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে সেমিটিক জাতি ইহুদিদের শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে জার্মানি বিশ্বকে ব্যথিত করেছে। দেশটির সর্বোচ্চ গর্ব এখানেই স্পষ্ট হয়েছে। জার্মানি অবশ্যই দেখিয়েছে, জাতি ও সংস্কৃতির জন্য এটা প্রায় অসম্ভব যে মতভেদগুলো মূলে চলে যাচ্ছে, একটি অভিন্ন সমগ্রতায় আত্মীকৃত হবে, জানা ও লাভবান হওয়ার জন্য হিন্দুস্থানে আমাদের জন্য একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত।’

আমি আশা করে বসেছিলাম যে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদি তার পুরোনো পন্থা ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তার নজরদারিতে স্থানীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ২০০২ সালের কর্মসূচির জন্য তাকে বৈশ্বিক কুখ্যাতি এনে দিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের অধীন যুক্তরাষ্ট্র তার ভ্রমণ ভিসা প্রত্যাখ্যান করেছিল। ভিসা প্রত্যাখ্যানের তালিকায় তিনি স্লোবোদান মিলোসেভিসের সহযোগী হয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির প্রথম মেয়াদ দলিত, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যার মাধ্যমে উদযাপন করেছে উগ্র হিন্দুরা।

অধিকৃত কাশ্মীরে প্রতিরোধকারীদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রীয় সহিংসতা দেখেছি। তরুণ কাশ্মীরদের চোখ লক্ষ্য করে ছররা গুলি নিক্ষেপ শুরু হয়েছে। এভাবে শত শত স্থানীয়কে অন্ধ করে দিচ্ছে তার সরকার।

গত ৫ আগস্ট সবচেয়ে জঘন্য ও উদ্ধত সিদ্ধান্তটি নেয় ভারত। দেশটির সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের মাধ্যমে অধিকৃত কাশ্মীরের সাত দশকের বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা কেড়ে নেয় মোদির সরকার।

ভারতীয় সংবিধানের অধিনেই এই উদ্যোগ অবৈধ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এটা কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন।

কাশ্মীরে সামরিক কারফিউ আরোপ করে মোদির ‘নতুন ভারত’ সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। অধিবাসীদের তাদের নিজ বাড়িতেই বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাদের ফোন, ইন্টারনেট ও টেলিভিশন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।

বিশ্ব থেকে একেবারে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে তাদের। এমনকি প্রিয় স্বজনদের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি নজিরবিহীন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে কাশ্মীরকে। হাজার হাজার কাশ্মীরিকে আটক করে ভারতের বিভিন্ন কারাগারে ভরা হয়েছে। এতে কারফিউ তুলে নেয়ার পর সেখানে রক্তের বন্যা বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কারফিউ তুচ্ছ করে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়া লোকজনকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।

কাশ্মীর ও সেখানকার অধিবাসীদের ওপর ভারতীয় হামলা বন্ধে যদি বিশ্ব কিছুই না করে, তবে দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশ যখনই সামরিক সংঘাতের কাছাকাছি চলে যাবে, তখন এতে পুরো বিশ্বের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি রয়েছে।

পরমাণু অস্ত্র প্রথমে ব্যবহার না করার ক্ষেত্রে ভারতীয় নীতি ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানকে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ভারতীয় নেতারা বিভিন্ন সময় এমন ধরনের বিবৃতি দিয়েছেন।

প্রথমে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করার ভারতীয় নীতি পাকিস্তান দীর্ঘদিন থেকেই সন্দেহের চোখে দেখছে। যখন পরমাণু অস্ত্রের ছায়া দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, তখন আমরা মনে করছি, অন্য পক্ষকে পরাজিত করার মানসিকতা থেকে সরে এসে কাশ্মীর, বাণিজ্য ও বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সংলাপে বসতে হবে।

কাশ্মীর নিয়ে সংলাপে বিশেষভাবে কাশ্মীরিসহ সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিকল্পের প্রস্তুতি নিয়েছি, যা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতিশ্রুত কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে যখন সম্মান জানানো হবে, তখন যাতে তা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।

সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীরের কয়েক দশকের ভোগান্তির একটা স্থায়ী সমাধান এবং স্থিতিশীল ও ন্যায়সঙ্গত শান্তির দিকে এগোতে পারবে সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সংলাপ তখনই শুরু হতে পারে, যখন কাশ্মীরকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে অবৈধ সংযুক্তির সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসবে ভারত।

এছাড়া কারফিউ ও অচলাবস্থা তুলে নেবে এবং মুসলমানদের অধ্যুষিত অঞ্চলটি থেকে সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবে।

এখন ব্যবসা ও বাণিজ্যিক সুবিধাকে ছাড়িয়ে চিন্তা করতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। এটা খুবই অপরিহার্য। মিউনিখে প্রশমিতকরণ নীতির কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ঠিক একই হুমকি আবার বিশ্বের সামনে এসে হাজির হচ্ছে।

কিন্তু এ সময়ে এসে তা ঘটতে যাচ্ছে পারমাণবিক ছায়ায়।

লেখক: ইমরান খান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী

Check Also

ডিসেম্বরের ২১ দিনে রেমিট্যান্স এল ২ বিলিয়ন ডলার

চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২১ দিনে দেশে বৈধ পথে ২০০ কোটি  মার্কিন (২ বিলিয়ন) ডলারের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।