অনিয়ন ও দুর্ণীতির কারণে তালার শাহী মসজিদে নামাজ বন্ধের উপক্রম

আবু সাইদ বিশ্বাস:ক্রাইমর্বাতা রিপোট: সাতক্ষীরা: দীর্র্ঘ ১০ বছর সংস্কার না হওয়াতে মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন তালার তেঁতুলিয়া শাহী জামে মসজিদের কার্যক্রম বন্ধের উপক্রম। জুম্মার দিনে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিরা মসজিদে জায়গা না পেয়ে সড়কে বসেই নামাজ আদায় করে। ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণের নামে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের গাফিলতিতে মসজিদটিতে নামাজ বন্ধের উপক্রম। একটু বষ্টি এলেই মসজিদের ভেতরে পানি পড়ে। নেই টয়লেট। ভেঙ্গে পড়ছে মসজিদটির ছাদ ও দেয়াওল। একবার তালা ইউএনও,একবার জেলা প্রশাসক ও খুলনা বিভাগীয় প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়ে ধর্ণা দিয়েও কোন কাজ হচ্ছে না বলে কর্তৃপক্ষের অভিযোগ। স্থানীয়দের দাবী প্রতœতত্ত সংরক্ষণ ও সংস্কারের নামে সরকার প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণে বরাদ্ধ দেয় তা যায় কোথায়। শুধু তালা তেঁতুলিয়া শাহী জামে মসজিদের নামে বিগত ১০ বছরে সরকারের বরাদ্ধের ১০ লক্ষ টাকার ও কোন হদিস নেই। সংস্কার করতে না দেওয়ায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে মসজিদটি।

আঠারোশ শতকের মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া শাহী জামে মসজিদ। প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক মসজিদটি স্থানীয়ভাবে মিয়ার মসজিদ হিসেবে পরিচিত। মূল নাম খান বাহাদুর কাজী সালামতউল্লাহ জামে মসজিদ হলেও বর্তমানে এটি তেঁতুলিয়া শাহী জামে মসজিদ নামেই পরিচিত।

‘মোগল মুমেন্টস অব বাংলাদেশ’ নামক গ্রন্থ দ্বারা প্রকাশিত হয় মৌলভী কাজী সালামতউল্লাহ খান বাহাদুর তেঁতুলিয়ার একজন জমিদার ছিলেন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় ব্রিটিশ শাসনামলের ডেপুটি কালেকটর এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

জমিদার কাজী সালামতউল্লাহ আঠারো শতকের দিকে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সাল নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। ১৮১৮, ১৮২৫ কিংবা ১৮৫৮-৫৯ সালে মসজিদটি নির্মাণ করা হয় বলে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। মসজিদের খুব কাছে ‘সালাম মঞ্জিল’টিও সমসাময়িক কালে কাজী সাহেব প্রতিষ্ঠা করেন।

মসজিদটি খুলনা-পাইকগাছা সড়কের কোল ঘেঁষে তালা উপজেলা সদরের দুই-তিন কিলোমিটার উত্তরে আঠারো মাইল অভিমুখে আঞ্চলিক সড়কের পাশে এক একর জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। মসজিদের সঙ্গেই প্রায় দুই একর আয়তনের একটি বিশাল পুকুর রয়েছে। মসজিদটিতে রয়েছে ৭টি দরজা। প্রতিটি দরজার উচ্চতা ৯ ফুট এবং প্রস্থ ৪ ফুট। ১০ বর্গফুট বেড়বিশিষ্ট ১২টি পিলারের ওপর মসজিদের ছাদ নির্মিত। চুুনসুরকি ও চিটাগুড়ের গাঁথুনিতে নির্মিত মসজিদটিতে ১৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ৬টি বড় গম্বুজ এবং ৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ১৪টি মিনার রয়েছে। এছাড়া ২৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট চার কোণে ৪টি মিনার রয়েছে। ১৯৮৭ খ্র্রিস্টাব্দে মসজিদটি প্রতœতাত্ত্বিক অধিদফতর তাদের আয়ত্তে নিয়েছে। সেখান থেকেই অবহেলিত রয়েছে মসজিদটি।

মসজিদের সামনে তৈরি একটি পেটে লন্ডনপ্রবাসী মন্টি সিদ্দিকী (কাজী সালামতউল্লাহর বংশধর) নামের ওই ব্যক্তির দেওয়া তথ্যমতে, মসজিদটির সঙ্গে ১৮৪০-৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতার শাহজানী বেগম মসজিদ এবং ১৮৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।

বর্তমানে অযতœ আর অবহেলায় ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটির সৌন্দর্য নষ্ট হতে বসেছে। ৭টি মিনার ভেঙে পড়ার উপক্রম। মসজিদের বাউন্ডারি এলাকায় বহু অজানা ব্যক্তির কবরের চিহ্ন থাকলেও সেগুলো অরক্ষিত। মসজিদটির ফ্লোরে ও পশ্চিম পাশের দেয়ালের উপরের অংশে ফাটল ধরেছে।
সরকারী ভাবে মসজিদটি পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে মুসল্লিদের দান খয়রাতের উপর চলছে ইমাম সমুয়াজিনের বেতন দেয়ার কাজ।
৪০ বছর ধরে দায়িত্বে থাকা মসজিদটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি মারুফ হোসেন (তুরান) জানান, ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে মসজিদ কমিটি মসজিদের কোন সংস্কার কাজ করতে পারে না। ঐতিহ্য নষ্ট হবে এমন অভিযোগ তুলে উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। এক জন তত্ত্বাবধায় দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয় না। মসজিদের খরচ বহন করার কথা থাকলেও তা করা হয়না।
সূত্র মতে মসজিদটিতে এক জন খতিব ,এক জন ওয়াক্তি ইমাম,একজন মুয়াজিন,একজন খাদেম রয়েছে। সীমিত সম্মানী দেয়া হয় তাদেরকে ।
মুসল্লিরা জানান, মসজিদের পরিচালনা কমিটি থাকলেও মসজিদের সংস্কার ও অন্য কাজ কার কমিটির এখতিয়ার নেই।
মসজিদের খতিব মাওলানা আব্দুর রব জানান, মসজিদটি বহু পুরনো। কর্তৃপক্ষের অনেক কর্মকর্তা এসে দেখে গেছেন। সংস্কারের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো উন্নয়নের ছোঁয়া পড়েনি। মসজিদের গুম্বুজের কয়েকটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় মুসল্লিরা মসজিদের ভেতরে নামাজ আদায় করেন।
এ ব্যাপারে খুলনা বিভাগীয় প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, আমরা সম্প্রতি মসজিদটি পরিদর্শন করেছি। ইতঃপূর্বে মসজিদের সংস্কার সংরক্ষণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, মসজিদটির নিয়মিত পরিষ্কার পরিছন্নতা ও দৈনন্দিন পরিচর্যার জন্য একজন দৈনিক শ্রমিককে নিয়োজিত রাখা হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে এর প্রয়োজনীয় সংস্কার সংরক্ষণ কাজের পরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কিন্তু সরজমিনে সে শ্রমিকের দেখা মেলেনি।
যদি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ না করা হয়, তা হলে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী তেঁতুলিয়া শাহী জামে মসজিদটি কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবে বলে সচেতন এলাকাবাসী মনে করছে।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।