নারায়ণগঞ্জে আলোচনায় হারুনের আদালত

ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট:   ঢাকা থেকে শিল্পপতির পরিবারের সদস্যদের তুলে নেয়ার অভিযোগ আসার পর প্রত্যাহার করা হয় নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদকে। তাকে অপসারণের পর এ ধরনের আরো অনেক অভিযোগ আসছে স্থানীয়দের কাছ থেকে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, যে কায়দায় ওই শিল্পপতির পরিবারকে চাপ দেয়া হয়েছিল টাকার জন্য একই কায়দায় তিনি টাকা আদায় করতেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কাছ থেকে। বাধ্য হয়ে টাকা দিলেও এতোদিন কেউ অভিযোগ করেননি। সরজমিন এলাকা ঘুরে এমন কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে বেশ কিছু তথ্য। অভিযোগকারীরা এতোদিন চুপ থাকলেও এখন প্রকাশ্যে অভিযোগ দেয়ার কথা বলছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হলেও তার অনুগতরা এখনও রয়ে গেছেন। তাই তারা নিরাপত্তা নিয়েও ভাবছেন
পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে বসেই গত সেপ্টেম্বরে রায় দেন প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যে কেনা জায়গা ছেড়ে দিতে হবে জসিম উদ্দিনকে। ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন নারায়ণগঞ্জের মুক্তারপুরে হামিদা সালাম নামে এক নারীর কাছ থেকে ৩১২ শতাংশ জায়গা কিনেন। বায়নাপত্র কেনার পর জানতে পারেন জায়গাটি অগ্রণী ব্যাংকে দায়বদ্ধ। পরবর্তীতে হামিদা সালামের কাছ থেকে পাওয়ার এর্টনি নেন তিনি। কথা ছিলো ব্যাংকে টাকা শোধ করে তাকে রেজিস্ট্রি করে দেয়া হবে। এরমধ্যেই জসিম উদ্দিনকে ডেকে নেন পুলিশ সুপার হারুন। এলাকার মাস্তানের মতোই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এই জায়গা ছেড়ে দিতে হুমকি দেন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, আমার কথাই আইন। আমার কথা না শুনলে পিটিয়ে হাত, পা ভেঙ্গে পঙ্গু করে দেব।’ এতে আতঙ্কিত হয়ে যান জসিম। তারপর ২১শে সেপ্টেম্বর এসপির নির্দেশে ডিবি পুলিশের একটি দল হামিদা সালামের পক্ষে ওই জায়গা দখলে নেয়। পরবর্তীতে জসিম আদালতের দ্বারস্ত হলে ওই জায়গার ওপর স্থিতিতাদেশ দেয়া হয়। কয়েক মাস আগে এসপির আদালতে ডাক পড়ে গার্মেন্টের অতিরিক্ত সুতা বা বন্ড ব্যবসায়ীদের। এসপি জানিয়ে দেন ডিবি’র পরিদর্শক এনামুল যা বলে তাই শুনতে হবে। তারপর নারায়ণগঞ্জের  টানবাজারে ব্যবসায়ীদের গোডাউনে হানা দেয় এনামসহ পুলিশ সদস্যরা। বাধ্য হয়েই চার থেকে সাত লাখ করে টাকা দেন একেক ব্যবসায়ী। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই আটক করে নিয়ে যাওয়া হতো থানা হাজতে। এমন অনেক ঘটনার মধ্যে একটির শিকার সিদ্ধিরগঞ্জের বালু ব্যবসায়ী শাহজাহান। দুই মাস আগে এক সন্ধ্যায় ঘটে ঘটনাটি। এসপি হারুনের ছক অনুসারে নাসিকের সাত নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলী হোসেন আলার কার্যালয়ে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশের এসআই আলমগীরের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী শাহজাহানকে আটক করে নিয়ে যায়।

কাউন্সিলর আলা জানান, তার কার্যালয় থেকে ডিবি পুলিশ শাহজাহানকে তুলে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে কাউন্সিলর আলাকেও ডেকে নেয় ডিবি। ডিবি অফিসে নিয়ে শাহজাহানের কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। এসময় তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। মাদক মামলায় ফাঁসানো থেকে শুরু করে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখানো হয়। একপর্যায়ে ২০ লাখ টাকা দিতে সম্মত হন ওই ব্যবসায়ী। শাহজাহানের প্রাণ রক্ষার্থেই সেই রাতে কাউন্সিলর আলার উপস্থিতিতে নগদ ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হলেও মুক্তি মেলেনি। পরদিন সকালে আরও ২২ লাখ টাকা (মোট ৩৯ লাখ ৫০ হাজার) দিয়ে মুক্তি মেলে শাহজাহানের। এ ঘটনার পর থেকে ব্যবসায়ী শাহজাহান অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।

নারায়ণগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনকে ডেকে নিয়ে ৪৫ লাখ টাকা আদায় করেন বলে এসপি হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে জনৈক ব্যবসায়ী গত ২৩শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় একটি জিডি করতে গেলে এই অভিযোগটিকে ২২ লাখ টাকার চাঁদাবাজীর মামলায় রূপ দেন এসপি হারুন। এই অভিযোগে জয়নালকে নারায়ণগঞ্জ থানায় ডেকে নিয়ে গ্রেপ্তার করেন তৎকালীন ওসি কামরুল। এসময় তার কাছে এসপি’র নির্দেশের কথা বলে ১ কোটি টাকা দাবি করা হয়। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে আরো মামলার হুমকি দেয়া হয়। পরে ২০ লাখ টাকা দিতে রাজী হন জয়নাল। কিন্তু তাতে হারুনের মন ভরেনি। তাই আরও তিনটি মামলা করানো হয়। অবশেষে মামলা ও রিমান্ড নিয়ে নির্যাতন করার ভয়ে ৪৫ লাখ টাকা দেন জয়নাল। এই টাকা পাওয়ার পর নমনীয় হন হারুন। জয়নাল আবেদীন বলেন, আমি নিজ হাতে তিন বারে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি এসপি হারুনের কাছে। বাকি টাকা দেয়া হয়েছে আমার স্ত্রী ও অন্যদের মাধ্যমে। এছাড়াও তিনি জানান, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অস্ত্র জমা দিতে যান জয়নাল। এসময় থানায় ফ্লোরে একটি গুলি পড়ে যায়। পরে এসপি হারুনের নির্দেশে তাকে আটকে রেখে অভিযোগ করা হয় জয়নাল পুলিশকে গুলি করেছেন। এ ঘটনায় মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করলেও এক পর্যায়ে ১৫ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হন জয়নাল আবেদীন।

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডের উৎসব পরিবহনের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে বিচারের নামে জবর দখলে সহযোগিতা করেন এসপি হারুন। বিবাদমান দুটি পক্ষই হারুনের শরনাপন্ন হলে প্রায় ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে এসপি হারুন একটি পক্ষকে সমর্থন দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে উৎসব পরিবহনের চেয়ারম্যান কামাল মৃধা বলেন, আমি বৃদ্ধ বয়সে গত ২০শে মে থেকে ১৯শে অক্টোবর পর্যন্ত কমপেক্ষ ৭০ বার এসপি অফিসে গিয়েছি। তিনটি লিখিত অভিযোগ করেছি কিন্তু আমি আইনি সহযোগিতা পাইনি।

এসপি হারুনের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ করেন পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ (রাসেল)। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে না পেয়ে তাঁর স্ত্রী-সন্তাানকে ঢাকার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। পরে তারা মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। ঘটনার বিষয়ে শওকত আজিজ বলেন, চাঁদা নিয়ে হারুন অর রশীদের সঙ্গে তার পুরোনো বিরোধ ছিল। সমপ্রতি তিনি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে নতুন একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছেন। সেখানেও হারুন বাগড়া দিচ্ছিলেন। রাসেল অভিযোগ করেন এর সূত্র ধরেই প্রথমে তার গাড়ি ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে মাদক দিয়ে গল্প সাজানো হয়। পরে তার স্ত্রী সন্তানকে তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটে। গুলশানের বাসা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও রাসেল তার ফেসবুকে শেয়ার করেন। এরপর ব্যবসায়ীদের তরফে প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নজরে আসলে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা হিসেবে এসপি হারুনকে প্রত্যাহার করা হয়। এসপি হারুনের চাঁদাবাজি নিয়ে ২০১৬ সালের ৫ই মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে রাসেল একটি লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচন কমিশনের আদেশে গাজীপুর থেকে প্রত্যাহারের পর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ তার কাছ থেকে ৫  কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। তাঁর পক্ষে উপপরিদর্শক আজহারুল ইসলাম আম্বার ডেনিমের স্টোর ম্যানেজার ইয়াহিয়া বাবুকে ফোন করে টাকা দাবি করেন। এর আগেও গুলশান ক্লাবের লামডা হলে ও গুলশানের কাবাব ফ্যাক্টরি রেস্তোরাঁয় হারুন তাঁকে ডেকে নিয়ে ৫ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঠিকানায় পাঠাতে বলেন। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আম্বার ডেনিমের ৪৫ জন শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গাজীপুর থানায় ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো হয়। উল্লেখ্য, গত ৪ঠা নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে নারায়গঞ্জের এসপি হারুন অর রশীদকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দপ্তরে (ট্রেনিং রিজার্ভ) সংযুক্তির আদেশ দেয়া হয়।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।