দাম বৃদ্ধিতে পেঁয়াজের বিশ্ব রেকর্ড

এইচ এম আকতার: লাগামহীন পেঁয়াজের বাজার। দাম বৃদ্ধিতে বিশ্ব রেকর্ড ডাবল সেঞ্চুরিতে পেঁয়াজ। গত চার মাসে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২৫ বার। কোনো কিছুতেই সেই দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না সরকার। আগের দিনের ১৭০ টাকার দেশি পেঁয়াজ গতকাল বৃহস্পতিবার গিয়ে ঠেকল ২০০ টাকা কেজিতে। ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা। ঢাকার বাইরে কোথায় আবার বিক্রি হচ্ছে ২১০-২২০ টাকায়। কি কারণে দাম বেড়েছে তা কেউ বলতে পারছে না। তবে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, দেশি পেঁয়াজের দাম ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা কেজি।

এদিন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজ ২০০ টাকা, মিসরীয় পেঁয়াজ ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা ও মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে।

আর সরকারি বিপণন সংস্থা টিবিসি বৃহস্পতিবারের পিঁয়াজের বাজার দর উল্লেখ করেছে, প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা। এরমধ্যে আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা এবং দেশি পিঁয়াজ প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা।

কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে এসে তর্কে জড়িয়ে গেলেন হাবিবা নামের একজন ক্রেতা। ২০০ টাকা পেঁয়াজের দাম বলাতে তিনি খেপে গিয়ে বলেন, গত মঙ্গলবার ১৪০ টাকায় পেঁয়াজ কিনেছি। ২ দিনে ৬০ টাকা বাড়ার কারণটা কী?

জবাবে দাম আরো বাড়বে উল্লেখ করে পেঁয়াজ বিক্রেতা বললেন, আপনি শিক্ষিত মানুষ। পেঁয়াজের সরবরাহ না থাকলে, দাম বাড়বে না কমবে, তা চিন্তা করে দেখেন। হঠাৎ করে দুইদিনেই ৬০ টাকা বেড়ে গেল কেন জানতে চাইলে পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রতা বাদশা বলেন, যেখানে ৫ ট্রাক পেঁয়াজ আসার কথা, সেখানে আসে মাত্র ২ ট্রাক। ৩ ট্রাকের ঘাটতি থেকে যায়। সে কারণে দাম বাড়ছে।

তবে দাম বাড়া-কমার বিষয়টি বর্তমানে সম্পূর্ণ আমদানিকারকের উপর নির্ভর করছে বলেও স্বীকার করেন তিনি। এই পাইকার বলেন, আমদানিকারকদের যদি দাম নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় তাহলে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা কমে যাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পেঁয়াজ-রসুন সমিতির প্রচার সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, শ্যামবাজারে ৭৮টি পেঁয়াজের আড়তের মধ্যে কেবল ৮টি আড়তে পেঁয়াজ রয়েছে। বাকিগুলোতে নেই।

সারাদেশের বাজারে প্রতিদিন কমপক্ষে চাহিদা ২শ’ ট্রাকের। কিন্তু আসে মাত্র ১০০ থেকে ১২৫ ট্রাক পেঁয়াজ। এতে ঘাটতি থাকে ৭০/৮০ ট্রাক পেঁয়াজ। প্রতি ট্রাকে সাধারণত ১৫ টন পেঁয়াজ আসে।

এই আড়তদার বলেন, টিসিবি ইচ্ছা করলে পেঁয়াজ আমদানি করতে পারে। এতে দাম কমতো। এখন শুধু বেসরকারিভাবে আমদানিকারকরা পেঁয়াজ আমদানি করে। কিন্তু আমদানিতে তাদের অনেক ভোগান্তি সইতে হয়। তবু তারা আমদানি করছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী আমদানি হচ্ছে না। তাই সরবরাহে ঘাটতি থেকেই যা। এই ঘাটতি প্রতিদিনই বাড়ছে। এ কারণে দাম হু হু করে বাড়ছে।

এই সমস্যা নিরসনে সরকারকেও পেঁয়াজ আমদানি করার পরামর্শ দিয়ে শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি আমার জন্মের পর হতে পেঁয়াজের দাম কখনও ২০০ টাকা শুনিনি। এটা রেকর্ড করলো। এই দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকেও পেঁয়াজ আমদানি করা দরকার।

রাজধানীর কাপ্তান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, পাইকারি বাজার থেকে গতকাল ১৯০ কেজিতে পেঁয়াজ কিনলাম। আসলে পেঁয়াজ খেতে হয়, তাই খাই। নচেত যে অবস্থা, খুব খারাপ, শোচনীয় অবস্থা। আগে সপ্তাহে অন্তত দুই কেজি কিনতাম, এখন সেটি কামিয়ে ১ কেজিতে নিয়ে এসেছি।

কাপ্তান বাজারের আরও এক পেঁয়াজ-রসুন বিক্রেতা বাবলু বলেন, মিশরের বড় বড় সাইজের পেঁয়াজ আজকে ১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে। আর বার্মানটা বিক্রি করছি ১৮০ টাকা কেজি। গতকালের চেয়ে আজকে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে কি কারণে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে তার কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।

তার দাবি, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৩০ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে ১৯ লাখ টন। এরমধ্যে পরিপক্ব হওয়ার আগেই তোলা হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টন। এতে মূল উৎপাদন টিকেছে ১৫ লাখ টন। তাহলে চাহিদা মেটাতে দরকার আরো ১৫ লাখ টন।

কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে যখন ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলো, সাথে সাথে আমরা সরকারকে বললাম, সরকারি ও বেসরকারিভাবে পেঁয়াজ আমদানি এখনই করতে হবে। নতুবা ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিবে। কিন্তু আমাদের কথায় গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বেসরকারিভাবে আমদানি করা হলেও এই পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে কি না আমার জানা নেই।

পেঁয়াজের এমন লাগামহীন দামে ক্ষোভ ক্রেতাদের মাঝে। পেঁয়াজের বাজার কারা নিয়ন্ত্রণ করছেন সে প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। মিয়ানমার থেকে ৪২ টাকা দরে পেঁয়াজ কেনার পরেও দেশে কোন অজুহাতে এত দাম? সে প্রশ্নও ক্রেতাদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান তাদের। বিক্রেতাদের দাবি, তাদের বেশি দামে কিনতে হয় বলেই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতার বিষয়ে কথা বলার জন্য গতকাল সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর দফতরে যান সাংবাদিকরা। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী দেশের বাইরে রয়েছেন, আর বাণিজ্য সচিব এ বিষয়ে গাণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি।

ঢাকার বাইরে পেঁয়াজের বাজার জ¦লছে আগুন। তাড়াশ সিরাজগঞ্জের তাড়াশ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চলনবিলে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ২১০ টাকা শাক সবজির দাম আকাশ ছোঁয়া বাজারে। ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর থেকে বাজারে এই অরাজকতা চলছেই। প্রশাসনিক কোন তৎপরতা বাজারে নেই। যে কারনে ইচ্ছেমত দাম নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার তাড়াশের নওগাঁ হাটে প্রতি কেজি পেয়াজ ২১০ টাকা বিক্রি হয়েছে। এ ব্যাপারে তাড়াশ উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ওবায়দুল্লাহকে জানালে কোন পদক্ষেপ নিতে রাজি নয়। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ফারুক বলেন ইউএনওরা যদি কিছু না করেন আমি এখান থেকে কি করতে পারি।

জামালপুর শহরের সবজি বিক্রেতা সমিতির সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, জামালপুর শহরে প্রতিদিন ৯০ থেকে ১০০ মণ পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে সরবরাহ কম থাকায় প্রতিদিন মাত্র ২০ থেকে ৩০ মণ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ কম থাকায় ক্রেতারা পেঁয়াজ পাচ্ছেন না। অনেক আড়তদার পেঁয়াজ এখন পাইকারি কিনে আনছেন না। পাবনা থেকে ১৭৫ টাকা কেজিতে এখন পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। তারপর পরিবহন খরচ রয়েছে। সব মিলে আমাদের আড়তে এসে পেঁয়াজের কেজি পড়ছে ১৮০ টাকা। তাহলে আমরা কত টাকা দরে বিক্রি করব। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় পেঁয়াজের দাম অনেক বেশি।

জামালপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফরিদা ইয়াছমিন বলেন, প্রায়ই পেঁয়াজের বাজারে আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা হয়ে থাকে। পেঁয়াজের বাজারে কোন সিন্ডিকেট থাকলে, খোঁজখবর নিয়ে ওইসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়াও দ্রত সময়ের মধ্যেই বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ব্যবস্থা করা হবে।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকাল থেকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী বাজারে পেঁয়াজের কেজি ১৮০ টাকা। গত বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাটহাজারীর খুচরা ও পাইকারি বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয় ১১০ টাকা দরে। কিন্তু গতকাল সকাল থেকে ওইসব দোকানে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে ১৮০ টাকায়। এক লাফে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭০ টাকা।

চট্টগ্রামে মোহাম্মদ রুবেল নামে এক দোকানদার বলেন, গতকাল দোকানে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ১১০ টাকায়। বিকালে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পাইকারি দোকানে পেঁয়াজ কিনতে ফোন করে জানতে পারি দাম বেড়েছে। খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাইকারি দরে কিনতে হয়েছে ১৬০ টাকায়। গাড়ী ভাড়াসহ প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে খুচরা বাজারে ১৮০ টাকা দরে।

রুবেল বলেন, আগে প্রতিদিন দোকানে দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হতো। এখন বিক্রি করছি ২০ থেকে ৩০ কেজি পেঁয়াজ। পাইকাররা তাদের বলছেন বার্মা থেকে পেঁয়াজ আসছেনা তাই পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ।

অবিলম্বে পেঁয়াজের দাম কমানোসহ ৬ দফা দাবিতে রাজধানীর কাওরান বাজারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে খেটে-খাওয়া সারাধণ শ্রমিকরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর কাওরান বাজারের কাঁচাবাজার আড়ৎ সংলগ্ন ‘আমরা সাধারণ জনগণ’ এর ব্যানারে তারা এ বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এসময় সমাবেশে শতাধিক সাধারণ খেটে-খাওয়া শ্রমিকরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃত্ব দেন আয়োজক আমরা সাধারণ জনগণের আহ্বায়ক ফিরোজা বেগম। ৬ দফা দাবিগুলো হলো- দ্রব্যমূল্য হ্রাসকরণ, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ, ও যানজট নিরসন করা।

আমরা সাধারণ জনগণের আহ্বায়ক ফিরোজা বেগম বলেন, আমরা খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ। আমরা দিন এনে দিন খাই। একদিন কাজ করতে না পারলে আমাদের না খেয়ে দিন-রাত কাটাতে হয়। এর মধ্যে প্রতিনিয়ত যেভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে তাতে আমাদের মতো খেটে-খাওয়া সাধারণ শ্রমিকদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। ২০/৩০ টাকার পেঁয়াজ এভাবে ২০০ টাকা হতে পারে না। এর পিছনে অবশ্যই কেই কলকাঠি নাড়ছে। অবিলম্বে পেঁয়াজের দাম কমানোর জন্য আমরা সাধারণ জনগণ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। পাশাপাশি অন্যান্য সকল পণ্যের দাম ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, আমরা কাওরান বাজারের কাঁচা বাজার আড়তের দিন-মজুর। আমরা পণ্য উঠা-নামা করি, বাজার পরিস্কার-পরিচ্ছন রাখি। হঠাৎ এই বাজার উচ্ছেদ করলে আমরা বিপদে পরে যাই। এতে আমাদের না খেয়ে থাকতে হয়। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন, আমাদের কোনো কাজের ব্যবস্থা বা পুনর্বাসন না করে উচ্ছেদ করবেন না। আমরাতো বেশি কিছু চাই না। আমাদের বাড়ি-গাড়ি-অট্টালিকা গড়ার স্বপ্ন নেই। আমরা তিন বেলা পেট ভরে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আমাদের সেই ডাল-ভাতও যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পরিবারের অন্য সদস্যসহ আমাদের না খেয়ে মরা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। এজন্য আমাদের একটাই দাবি- আমাদের কোনো কাজের ব্যবস্থা বা পুনর্বাসন না করে উচ্ছেদ করবেন না।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।