দেশে খেলাপি ঋণের উল্লম্ফন : অশনি সঙ্কেত অর্থনীতিতে

ক্রাইমর্বাতা রিপোট :ব্যাংকিং খাতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলছে শ্রেণীকৃত ঋণ। গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে প্রতি বছরই এ শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতিবিদরা এই অবস্থাকে অর্থনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাদের মতে, ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া, দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এ দশা হয়েছে। আর এটা চলতে থাকলে কাক্সিক্ষত হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৯ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে শ্রেণীকৃত ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল শেষে তা বেড়ে হয় ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এর মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে গত ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ। তবে খেলাপি ঋণ অবলোপন আছে আরো প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর এটা যোগ করলে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে হবে প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। যদিও আইএমের হিসেবে এটা দুই লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। আইএমএফ আদালতের স্থগিতাদেশ দেয়া খেলাপি ঋণ, ব্লক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত ঋণ এবং আদায় না হওয়া পুনঃতফশিলকৃত খেলাপি ঋণকেও এর মধ্যে হিসাব করেছে। খেলাপি ঋণ এভাবে বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের আয় থেকে বেশি হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। অনেক ব্যাংকের পক্ষে আয় দিয়েও এই প্রভিশনের সংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বেড়ে গেছে প্রভিশন ঘাটতি। গত সেপ্টেম্বর শেষে প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে আট হাজার ১২৯ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া, দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এ দশা হয়েছে। আর এটা চলতে থাকলে কাক্সিক্ষত হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। খেলাপি ঋণের এ উল্লম্ফনের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম গতকাল বুধবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, নানাভাবে ঋণখেলাপিদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। তারা সুদের হারে ছাড় পাচ্ছে। ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। নানাভাবে ছাড় পাওয়ার কারণে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন তারা ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এভাবে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। এ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণের আস্থা কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে আমানতের পরিমাণ। এতে প্রভাব পড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর। বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় কাক্সিক্ষত হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনও বাধাগ্রস্ত হবে বলে তিনি মনে করেন।

ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে চলছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকেও উদাসীনতার পরিচয় দেয়া হচ্ছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। নেই ব্যাংকিং খাত সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা। উপরন্তু নানাভাবে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে চলছে। আর এটা চাপানো হচ্ছে উদ্যোক্তা ও আমানতকারীদের ওপর। এক দিকে আমানতের সুদহার কমে যাচ্ছে। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ আমনতকারীরা। অন্য দিকে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। এতে বিদেশী পণ্যের সাথে মূল্যের প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে দেশী পণ্য। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে মার খাচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। অন্য দিকে দেশের ব্যাংকিং খাতও দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাড়ছে ঝুঁকির পরিমাণ। এভাবে চলতে থাকলে সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের ভাগ্য বরণ করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। এ থেকে উত্তরণের জন্য ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভালোভাবে ব্যাংকিং খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।

খেলাপি ঋণের গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ২২ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই ছিল। ২০১১ সালে ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। ২০১২ সালে এসে এক লাফে তা বেড়ে ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকায়। পরের বছর অনেক ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়। ফলে ২০১২ সালের চেয়ে ২০১৩ সালে খেলাপি ঋণ না বেড়ে বরং ২ হাজার কোটি টাকা কমে ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকায় আসে। এর পরের বছর খেলাপি ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয় ৫০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫ সালে খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের নামে মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়। ফলে ১৫ সালে খেলাপি ঋণ ১ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয় ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এরপর থেকে প্রতি বছরই খেলাপি ঋণ গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে বাড়তে থাকে। আগের বছরের যে ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয় তা আবার খেলাপি হতে থাকে। ফলে ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয় ৬২ হাজার কোটি টাকায়। ২০১৭ সালে আরো ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয় ৭৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছর শেষে ১৫ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয় ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।

এর পর গত জুন শেষে প্রথমবারের মতো খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে হয় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। যা তিন মাসের মাথায় গত সেপ্টেম্বরে মাথায় আরো ৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর নিট আয় কমে যাচ্ছে। কারণ, খেলাপি ঋণের বিপরীতে আমানতকারীদের নিরাপত্তায় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে মুনাফা থেকে। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ৬২ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু আয় কুলাতে না পারায় প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়েছে ৫৪ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ৮ হাজার ১২৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ ঋণই ১ লাখ ৪৭৩ কোটি টাকা, যা মোট শ্রেণীকৃত ঋণের ৮৬ দশমিক ৪০ শতাংশ।
তবে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের এক প্রতিবেদনে গত জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা; যা ওই সময়ে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ২৬ শতাংশ। এসবের মধ্যে আদালতের স্থগিত আদেশ, পুনঃতফসিল এবং বিশেষ অ্যাকাউন্টের ঋণও রয়েছে। এই পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেক; যা ৭টি পদ্মা সেতুর ব্যয়ের সমান।

আইএমএফের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, খেলাপি ঋণ আসলে দ্বিগুণ। বাংলাদেশ ব্যাংক ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার হিসাব দেখায়। কিন্তু আদালতের স্থগিত আদেশে ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকার ঋণ আটকে আছে। ৬৭৫ জন শীর্ষ ঋণগ্রহীতার আবেদনের ভিত্তিতে এই স্থগিত আদেশ দেন আদালত। ফলে ঋণখেলাপির হিসাবে দেখায় না বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণ এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এগুলোও খেলাপি ঋণের মধ্যে পড়ে। বিশেষ অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে ২৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা, ঋণখেলাপিদের ঘন ঘন ছাড় দেয়ার ফলে তাদের নগদ আদায় কমে গেছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, টেক্সটাইল, আবাসন খাতসহ বেশ কয়েকটি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আবার অনেকেই ইচ্ছেকৃতভাবে ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছেন বিশেষ সুবিধা নেয়ার জন্য। এতে ব্যাংকের তহবিলেও টান পড়েছে। নগদ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগযোগ্য তহবিল কমে যাচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের ঝুঁকির পরিমাণ। এক দিকে, ব্যাংকের বেতনভাতাসহ ইউটিলিটি বিল বেড়ে যাচ্ছে। অপর দিকে কমছে আয়। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।.dailynayadiganta.com

Please follow and like us:

Check Also

২৮শে এপ্রিল খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবারেও ক্লাসের পরিকল্পনা

আগামী ২৮শে এপ্রিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সব রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।