ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট: রহস্যজনক নিখোঁজ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত রাতে যশোরের বেনাপোলের রঘুনাথপুর সীমান্ত থেকে তাকে ‘উদ্ধার’ দেখায় বিজিবি। পরে তাকে বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে বিজিবি। পুলিশ অবৈধ অনুপ্রবেশ আইনে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে তাকে আদালতে প্রেরণ করে। মুখভর্তি দাঁড়ি, এলামেলো চুল আর অপ্রকৃতিস্ত চেহারায় সাংবাদিক কাজলের দুই হাত পেছনে দিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আদালতে এনেছিল পুলিশ। আদালত শুনানী শেষে ওই মামলায় সাংবাদিক কাজলকে জামিন দিলেও ঢাকায় দায়েরকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি মামলায় সাংবাদিক কাজলকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
যশোর আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) এএসআই সুবোধ ঘোষ জানান, সাংবাদিক কাজলকে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মঞ্জুরুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে পুলিশ তার নামে রুজু হওয়া মামলাগুলোর কথা তুলে ধরে।
কাজলের আইনজীবী দেবাশীষ দাসকে উদ্ধৃত করে তার সহকারী শিক্ষানবিস আইনজীবী সুদীপ্ত ঘোষ জানান, পুলিশ কাজলের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা (আজ রোববার বিজিবির রুজু করা) ছাড়াও রাজধানীর তিনটি থানায় আরো তিনটি মামলা থাকার কথা উল্লেখ করে। এই তিনটি মামলাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
গত ৯, ১০ ও ১১ মার্চ মামলা তিনটি হয় যথাক্রমে শেরেবাংলা নগর, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গির চর থানায়। আদালত এই মামলা তিনটি সম্বন্ধে কোনো আদেশ দেননি।
সদর আদালতের হাজতখানার ইনচার্জ পুলিশের এটিএসআই সন্তোষকুমার বিশ্বাস জানান, ৫৪ ধারায় রুজু করা মামলায় আদালত বিকেলে সাংবাদিক কাজলকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেই অনুযায়ী সন্ধ্যার আগেই তাকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ছাত্রজীবনে বামধারার রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন শফিকুল ইসলাম কাজল। নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বর্তমান সরকারের কঠোর সমালোচক ছিলেন।
যে ভাবে বেনাপোল সীমান্ত থেকে“ উদ্ধার” ঢাকা থেকে
নিখোঁজ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হওয়ার পর প্রায় দুই মাস ধরে নিখোঁজ অথবা অপহৃত সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে বেনাপোলের রঘুনাথপুর সীমান্ত থেকে উদ্ধার দেখিয়েছে পুলিশ। তবে এই উদ্ধারের ঘটনাকে স্থানীয় সাংবাদিকরা রহস্যজনক বলে মনে করছেন।
বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি মামুন খান বলছেন, শনিবার গভীর রাতে বিজিবি রঘুনাথপুর সীমান্ত থেকে এক ব্যক্তিকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে জানা যায়, ওই ব্যক্তি ঢাকা থেকে নিখোঁজ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। বিজিবি অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে থানায় একটি মামলা করেছে। ওই মামলায় আজ তাকে কোর্টে পাঠানো হলে আদালত তাকে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। সন্ধ্যায় তাকে আদালত থেকে জেলে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ আছেন।
এদিকে কাজলের স্ত্রী জুলিয়া ফেরদৌসী জানান, শনিবার রাত পৌনে তিনটার দিকে বেনাপোল থানা থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ফোন করে তাকে স্বামীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন।
“আমার ছেলেকে ও ফোনে বলেছে, ‘আব্বু আমি বেঁচে আছি, তোমরা সবাই আমাকে নিতে আস’।”
তাদের ছেলে মনোরম পলক সকালে আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বেনাপোলে পৌঁছান এবং বাবার সাথে দেখা করে কথা বলেন। পরে তার বাবাকে আদালতে উপস্থিত করা হলে পলকও আদালত প্রাঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন।
যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের রঘুনাথপুর ক্যাম্পের কমান্ডার হাবিলদার আশেক আলী বলেন, বেনাপোলের রঘুনাথপুর সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে প্রবেশের সময় ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে তাকে আটক দেখিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে ‘জড়িত’দের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে মাগুরা -১ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর বাদী হয়ে মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে যে মামলা করেন, তাতে আসামির তালিকায় কাজলের নামও রয়েছে। সরকার দলীয় সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখর গত ৯ মার্চ শেরেবাংলা নগর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ওই মামলা করেন। মামলা হওয়ার পরদিন ১০ মার্চ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ ছিলেন। কাজলের খোঁজ মিলছে না জানিয়ে প্রথমে চকবাজার থানায় জিডি ও পরে মামলা করেন তার ছেলে মনোরম পলক।
এক সময়ের জাসদ ছাত্রলীগ নেতা কাজল নিখোঁজ হওয়ার পর তার সন্ধান দাবিতে পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মী, স্বজন ও সাংবাদিকরা মাঠে নেমেছিলেন।
তাদের আন্দোলনের মধ্যে এক পর্যায়ে কাজলের একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ভিডিওতে কাজল নিখোঁজ হওয়ার কিছুক্ষণ আগের চিত্র উঠে এসেছে বলে দাবি সংস্থাটির।
ওই ফুটেজে কাজলকে একটি জায়গায় রাস্তার পাশে মোটরসাইকেল রেখে পাশের কোথাও যেতে দেখা যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে মোটরসাইকেল চালিয়ে যান তিনি। এর মধ্যে তার ওই মোটরসাইকেল ঘিরে কয়েকজনকে তৎপরতা চালাতে দেখা যায়।
তবে ওই ফুটেজ ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে তেমন কিছু মেলেনি বলে জানিয়েছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
এদিকে ঘটনার প্রায় ২ মাস পর সাংবাদিক কাজলকে বেনাপোলের রগুনাথপুর সীমান্ত থেকে উদ্ধার দেখায় বিজিবি। তবে এ্ উদ্ধারের ঘটনাকে রহস্য জনক বলছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। আজ যশোরের আদালতে সাংবাদিক কাজলকে হাজির করা হলেও উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে তারে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। মুখ ভর্তি দাঁড়ি ও এলোমেলো চুলে মলিন চেহারার কাজল এসময় আদালতের কাঠ গড়ায় দ৭াড়িয়ে সাংবাদিকদের দিখে ফ্যাল ফ্রাল নয়নে চেয়ে কি যেন বলতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু পুলিশী হস্তক্ষেপে সাংবাদিকরা কাজলের সাথে কথা বলতে পারেনি। তবে আদালত চত্বরে উপস্থিত কাজলের ছেলে পলক সাংবাদিকদের জানান, আমার বাবাকে ফিরে পেয়েছি এটাই বড় কথা। তিনি বেঁচে আছেন এটাই সত্য। এর বাইরে কিছু আপনারা জানতে চাইবেন না। আমরা আপনারা দোয়া ও সমর্থন প্রত্যাশা করছি।