জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক দুর্যোগ ঝুঁকির কবলে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চল: সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে নিঃস্ব হবে ২ কোটি মানুষ

জেলার ২০ ভাগ অঞ্চল সারাবছই জলাবদ্ধ থাকবে!
আবু সাইদ বিশ্বাস:ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ   সাতক্ষীরা: জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক দুর্যোগ ঝুঁকির কবলে পড়েছে সাতক্ষীরাসহ উপকূলূয় জেলা সমূহ। কয়েক দশকে দেশে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে বন্যা,নদী ভাঙ্গন ও বেঁড়ি বাধ ভাঙ্গনের ভয়াবহতা বেড়েছে। লবণাক্ততা, নদীভাঙ্গনসহ বহুমুখী দুর্যোগের কবলে পড়ছে উপকূলীয় এ জেলার প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে উপকূলীয় এ জেলার বসবাস অনুপোযগী হবে। নিঃস্ব হবে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের ২ কোটি মানুষ । ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০২০ সালের ২০ মে ঘূণিঝড় আম্ফানসহ ঘনঘন নিন্মচাপের পূর্বাভাস জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, আগামী ৫০ বছরে সমুদ্রর্পষ্টের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের ১৫-১৭ ভাগ এলাকা ২২১৩৫ থেকে ২৬৫৬২ বর্গকিলোমিটার এলাকা তলিয়ে যাবে। বিশেষ করে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহ তলিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা। এতে এসব অঞ্চলে উদ্বাস্তু হবে প্রায় ২ কোটি মানুষ। এদের আশ্রয় দেয়ার মতো জায়গা থাকবে না কোন সংস্থার। যেমনটা প্রভাব পড়েছে সম্প্রতি সাতক্ষীরার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘুর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার মানুষ গুলো। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর মত পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্রের হাতে নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
অন্যদিকে গবেষণা বলছে, প্রাকৃৃতিক দুর্যোগ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিক্ষয়, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, অতিবৃষ্টি বৃদ্ধিতে মানবসৃষ্ট ঝুঁকির কারণ ৫৮ ভাগ, ১৯ ভাগ ঝুঁকির কারণ প্রাকৃৃতিক বিপর্যয়, ১৬ ভাগ কারণ রাষ্ট্রশাসন কাঠামোগত বিপর্যয় এবং ৭ ভাগ অন্যান্য কারণ।

আইপিসিসি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। এদেশে বহুমূখী দুর্যোগের মাত্রা বাড়বে। এসব দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে উপকূলের মানুষ। অন্যদিকে ইউএনডিপি’র প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো উন্নয়নের জন্য চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৮০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চল্লিশ বছরে বিশ্বের ঘূর্ণিঝড়ে মৃত পাঁচ লাখ মানুষের মধ্যে ৬০ শতাংশই বাংলাদেশের। ফিলিপাইন বাংলাদেশের চেয়ে তিনগুন বেশি ঝুঁকিতে থাকলেও ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ফিলিপাইনের চেয়ে বাংলাদেশে ১০ গুন বেশি।

কয়েক দশকে দেশের উপকূল জুড়ে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। এর পাশাপাশি দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, সমুদ্র উপকূলের সরুপার্শ্বে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় ভৌগলিকভাবেই এই এলাকাটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা। ১৯৬০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ১৪টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে উপকূলে। এরমধ্যে মধ্যে ৫টিই আঘাত হেনেছিল ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে। এক গবেষণা তথ্যমতে, ১৮৭৭ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মোট ৩৬৫টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির রেকর্ড আছে, যা মূল ভূ-খন্ড আঘাত হানার আগেই দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব ঘূর্ণিঝড় মূল ভূ-খন্ডে আঘাত হানতে পারে।

গবেষণা সূত্র বলছে, ২০০১ সালের জনজরিপে দেখা গেছে, ৪৭ হাজার ২১১ বর্গ কিলোমিটারের উপকূল এলাকায় প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের বসবাস। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ হার ২০২০ সাল নাগাদ বেড়ে দাঁড়য় প্রায় সাড়ে চার কোটিতে। নদীভাঙন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসব অঞ্চলের মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে।
ভাঙ্গন কবোলিত সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার অন্তত ৫ হাজার পরিবার বসতভিটা হারিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর অনেকেই ভাসমান জীবন কাটাচ্ছে। ভাঙ্গনের এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৪০ বছরে সাতক্ষীরা জেলার নদীকবলিত এলাকা পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে।

একদিকে নদী ভাঙ্গনের কারণে সহায় সম্পদ হারানো, অন্যদিকে জীবিকার পথ সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় এখানকার কয়েক লক্ষ মানুষ সংকট পড়েছে। সরকার বছরের পর বছর নদী ভাঙ্গন ও বাঁধ রক্ষায় কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ফলে মানুষের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছে। নতুন করে চলতি মাসে এ অঞ্চলে,নদীভাঙ্গন, জলাবদ্ধতা নিরাশন ও বেড়িবাাঁধ সংস্কারে এক হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। মঙ্গলবার ২ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এর বৈঠকে সাতক্ষীরা শহরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী খনন করা হবে এবং উক্ত দুই সদী সংলগ্ন ৮৮টি ছোট-বড় খাল পূর্ণখনন করা হবে। এছাড়া আরো ৬শ কোটি টাকা ব্যয়ে আশাশুনি ও শ্যামনগরে বেড়ি বাঁধ নির্মান করা হবে বলে জানিয়েছে পানিউন্নয়ন বোড। এদিকে সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সাতক্ষীরার বেড়িবাঁধ ভেঙে সমুদ্রের লবণাক্ত জোয়ারের পানি কৃষি এলাকায় ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষিতে জরুরি ভিত্তিতে এই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানিয়েছেন।এত কিছুর পরও আশ্বস্ত হতে পারছে না উপক’লীয় অঞ্চলের মানুষ। তাদের দাবী বেঁড়ি বাঁধের নামে বছরে বছরে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিলেও কাজের কাজ কিছুইয় হয়না।

কথা হয় আশাশুনি ইপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের ,সুভদ্রাকাটি গ্রামের রমজান,শাহিন,রহিম,আবু বক্করসহ কয়েক জনের সাথে । তারা জানান,আমার অন্য মানুষগুলোরমত বাঁচতে চায়। মাথা গুজার ঠাই চায়। কিছু প্রতি বছরে নদী ভাঙ্গনে আমাদেও সবকিছু হারাতে হয়। এবছর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছি। গত ২০ মে ঘুলিঝড় আম্ফানের পর এখনো তাদেও ঘরবাড়ি স্বাভাবিক হতে পারিনি। প্রতিদিন স্বেচ্ছাশ্রমে বেঁড়ি বাঁধ সংস্কার করে যাচ্ছি। বাড়িতে পানি। থাকার জায়গা নেই। আমাগো একটায় দাবী স্থায়ী টেকশই বেড়িবাঁধ নির্মান ।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল জানিয়েছে, সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে আশাশুনি,শ্যামনগরসহ ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় স্থায়ী টেকশই বেঁড়ি বাঁধ নির্মান, খাল ও নদীর প্রবাহ সৃষ্টি,জলাবদ্ধতা নিরাশনে সরকার এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইত্যোমধ্যে সেনাবাহিনী কাজও শুরু করেছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাসমূহে যা যা করণীয় তাই করা হবে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে যারা বেঁড়িবাধ সংস্কারে সহযোগীতা করছেন তাদেরকে তিনি ধোন্যবাদ জানান।
আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: ০২/০৬/২০২০

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।