মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ: ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশী নামক স্থানে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাই পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন, বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয় এবং সমগ্র ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়।
ইংরেজি ১৬০০ সালে ব্রিটিশ রাণী এলিজাবেথের অনুমোদন ক্রমে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসা শুরু করে । ১৬৫০ এর দশকের প্রথম থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে হুগলি ও কাসিমবাজারে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলে। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে তাদের অনুপ্রবেশ বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান ও ইংরেজদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শায়েস্তা খান পরবর্তী সময়ে ১৬৯০ সালে জব চার্নকের নেতৃত্বে ইংরেজরা কলকাতায় বসবাস করার অধিকার পায় এবং কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানটি নামে তিনটি গ্রাম কিনে তারা কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করে।
১৭১৭ সালে মুগল সম্রাট ফররুখ সিয়ারএর এক ফরমান এর মাধ্যমে নামমাত্র বার্ষিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য, কলকাতায় টাকশাল স্থাপন এবং ৩৮টি গ্রাম ক্রয় করার অধিকার প্রদান করেন। যেহেতু অন্যান্য ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট হারে শুল্ক দিতে হতো, আর ইংরেজ ও তাদের সহযোগীরা শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করত, তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য থেকে উৎখাত হওয়ার ভয় দেখা দেয়। নবাব মুর্শিদকুলী খান ফরমানের বাস্তবায়নে বাধা দেন। নবাব আলীবর্দি খাঁর জীবদ্দশাতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বাংলার শাসকের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। বাংলার নবাব আলীবর্দি খান দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে ব্রিটিশ শক্তির অবাঞ্ছিত প্রভাব বিস্তার প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তবে তিনি সিরাজউদ্দৌলাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুরভিসন্ধি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে যান।
১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজউদ্দৌলার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নবাব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে বিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ব্রিটিশরা অনুমতি ব্যতীত ফোর্ট উইলিয়মে প্রাচীর নির্মাণ ,পরিখা খনন ও নবাবের ৫৩ লক্ষ টাকা আত্মসাতকারী কর্মচারী কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় প্রদান করে। নবাব কোম্পানির নিকট কৃষ্ণদাসকে তাঁর হাতে সমর্পণের এবং নতুন প্রাচীর ভেঙে ফেলতে ও কলকাতার চারদিকের পরিখা ভরাট করতে নির্দেশ দেন। কলকাতার ইংরেজ গভর্নর রজার ড্রেক যে চরম অপমানজনকভাবে নবাবের প্রতিনিধি নারায়ণ সিংহকে বিতাড়িত করে। নবাব তৎক্ষণাৎ কাসিমবাজার কুঠি অবরোধের আদেশ দেন। কুঠির প্রধান আত্মসমর্পণ করে এবং নবাব কলকাতা দখল করে নেন। কোম্পানি অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর জন্য মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জে জরুরি খবর পাঠায়। সেখান হতে রবার্ট ক্লাইভ ও এডমিরাল ওয়াটসনের অধীনে একদল ব্রিটিশ সৈন্য বাংলায় পাঠানো হয়। তারা ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এবং নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে আলীনগরের সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।
ইংরেজরা সন্ধির শর্তাদি ভঙ্গ করতে থাকায় যুদ্ধের উত্তেজনা চলতে থাকে। সিরাজউদ্দৌলার নবাব পদে অধিষ্ঠান আলীবর্দি খাঁর অন্যতম নিকটাত্মীয় ও প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান ,কন্যা ঘসেটি বেগম ,জ্ঞাতি ভ্রাতা শওকত জঙ সহ অনেক অমাত্য এটা মেনে নিতে পারেননি। মীর জাফর আলী, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ,রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ,নন্দকুমার,স্বরূপচাঁদ,মাহতাবচাঁদ, ইয়ার লতিফসহ প্রভাবশালী রাজন্যবর্গ ও ধনকুবেররা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। তারা নবাবকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে তৎপরতা শুরু করে। ক্লাইভ মীরজাফরের কাছ থেকে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বার্তা পান। ক্লাইভের নেতৃত্বে তিন হাজার ব্রিটিশ বাহিনী ২২ জুন মধ্য রাতের পর পলাশীতে অবস্থান গ্রহন করে।
ইতোমধ্যে নবাব মুর্শিদাবাদ থেকে রওয়ানা দেন এবং ইংরেজদের মোকাবিলা করার জন্য পলাশীর আম্রকাননে শিবির স্থাপন করেন। এর উত্তর-পশ্চিম দিকে ভাগীরথী নদী। এর উত্তর-পূর্ব দিকে দুই বর্গমাইলব্যাপী আম্রকানন । ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল ৮টার দিকে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। অন্যদিকে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভ এর অধীনস্ত নবাবের প্রায় পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের অধিকাংশই নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে । মীর মর্দান, মোহন লাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নব সিং হাজারী প্রমুখের নেতৃত্বে মাত্র ৫০০০ নবাব সেনা বীরত্বের সঙ্গে ইংরেজদের মোকাবেলা করেন। তাদের প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে বেলা তিনটার দিকে কামানের গোলা মীর মর্দানকে আঘাত হানে এবং এতে তাঁর মৃত্যু হয়। খাজা আব্দুল হাদী খান ও নবে সিং হাজারী প্রমুখ একইসাথে মৃত্যুবরণ করেন।
হতভম্ব নবাবকে মীরজাফর ঐ দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করতে পরামর্শ দেয়, আর এ খবর শীঘ্র ক্লাইভের নিকট পৌঁছানো হয়। ইংরেজ সেনারা নতুন উদ্যমে নবাব বাহিনীর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায় এবং ফলে নবাব বাহিনী বিশৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র পালিয়ে যায়। বিকেল ৫টার দিকে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় এবং বিজয়ী ক্লাইভ বীরদর্পে তখনই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করেন। সিরাজউদ্দৌলা নৌকাযোগে পলায়ন করেন। রাজমহলে শত্রূর হাতে বন্দী হন। তাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে এনে নতুন নবাব মীর জাফরের দরবারে উপস্থিত করা হলে মীর জাফর সিরাজের ‘বিচারের ভার’ নিজের পুত্র মিরনের হস্তে অর্পণ করেন। মিরনের নির্দেশে সিরাজের এক সময়ের অনুচর, নিষ্ঠুর মুহাম্মদী বেগ তাকে রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পলাশীর পরাজয় শুধু এদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে হরণ করেনি, এর পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক, প্রশাসনিক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেএক বিপর্যয় সৃষ্টি করে । তাদের ক্ষমতা দখলের তের বছরের মাথায় ইংরেজি ১৭৭০ সাল মোতাবেক বাংলা ১১৭৭ সালে দেশবাসী এক মহাদুর্ভিক্ষের শিকার হয়। এতে বাংলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক পথে ঘাটে না খেয়ে মৃত্যবরণ করে। তাদের প্রশাসনিক ও ভুমি ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন হাজার হাজার স্বচ্ছল পরিবারকে পথের ভিখিরিতে পরিণত করে। এটা কখনও ধীর, কখনও দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হয়। উইলিয়াম হান্টারের মতে , তখন বাংলার প্রায় এক-চতুর্থাংশ ভুমি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য লাখেরাজ/নিষ্কর বা ওয়াকফ করা ছিল ।এতে স্বয়ং সম্পূর্ণ এক শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলার প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ সমস্ত জমির আয় দিয়ে শিক্ষকদের বেতন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় ব্যয় মেটানো হতো। ইংরেজরা হিসাব করে দেখে যে, এ সমস্ত লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে পারলে বার্ষিক আরও ৮ লক্ষ পাউন্ড বেশি আয় সম্ভব। এ সব লাখেরাজ ভূমি বাতিলের ফলে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দেশীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত হয়। পরবর্তি ৫০ বছরের মধ্যে বিশেষত মুসলমানরা শিক্ষা দীক্ষাহীন এক জাতিতে পরিণত হয়। কোটি কোটি টাকার সম্পদ তারা লুট করে ইংল্যান্ডে পাঠাতে থাকে। ধন সম্পদে পরিপূর্ণ বাংলা পৃথিবীর এক দরিদ্র দেশে পরিণত হয়।
*লেখক : প্রভাষক , সাতক্ষীরা পিএন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাতক্ষীরা।