সাতক্ষীরায় ১০ টাকায় ছাগল ও ৫০ থেকে একশ টাকায় গরুর চামড়া বিক্রি

ক্রাইমর্বাতা রিপোট: সাতক্ষীরা:   সাতক্ষীরায় পানির দরে কোরবাণীর পশুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে। ছাগলের চামড়া ১০ টাকা আর গরুর চামড়া  ৩০ থেকে ৫০ টাকা । অনেক জায়গাতে ২শ থেকে আড়াইশ টাকায় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে। তাই চামড়া বিক্রি না করে মাদ্রাসা,মসজিদ ও ইয়াতিম খানায় দান করতে দেখা গেছে।

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতার কারণে সিনথেটিক পণ্যের ব্যবহার কমে আসায় চামড়াশিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাড়ছে চামড়াজাত পণ্যের ব্যবহার। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি নীতিগত সহায়তা এবং ভুল পদক্ষেপের কারণে সম্ভাবনাময় হাজার কোটি টাকার চামড়াশিল্পটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের বিশৃঙ্খল নীতিমালার সুযোগে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পানির দামে পাচার হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার মূল্যবান পশুর চামড়া। আর সেই সুযোগে ফুলেফেঁপে উঠছে ভারতীয় চামড়াশিল্প।
গত বছর করোনার মতো কোনো ধরনের দুর্যোগ না থাকলেও চামড়ার দামে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল। লাখ টাকা দামের পশুর চামড়া কয়েকশ’ টাকায়ও বিক্রি করতে না পেরে ক্ষোভে মানুষ কুরবানির পশুর চামড়া শেষ পর্যন্ত মাটিচাপা দিয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ বছরও পরিস্থিতি খুব একটা সুখকর হবে না। ইতোমধ্যে সরকারিভাবে গতবারের চেয়ে চামড়ার দাম আরো প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ২৮ থেকে ৩২ টাকা। গত বছর ঢাকায় এই দাম ছিল ৪৫-৫০ টাকা, তার পরও চামড়া ক্রয়ে এ দাম কেউ মানেনি। চামড়া ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যাপক বিপর্যয় হয়েছিল। আর এ বছর দাম কমানো হয়েছে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩০%। আর ঢাকার বাইরে গত বছর গরুর চামড়ার দাম ছিল ৩৫-৪০ টাকা, যা এবার প্রায় ২০% কমানো হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী গত ২৬ জুলাই এক অনলাইন বৈঠকে এ বছরের চামড়ার এই দাম ঘোষণা করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩-১৫ টাকা। গত বছর এই দাম ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা। গত বছরের তুলনায় ছাগলের চামড়ার দাম কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ।
কুরবানির ঈদের পর প্রতি বছরই পশুর চামড়া পাচার হওয়া নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু বিগত কয়েক বছর সরকারি নজরদারি আর নীতিমালার অভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কাঁচা চামড়া সঙ্কটের সুযোগে কুরবানির পশুর চামড়া পাচারে সিন্ডিকেট চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চামড়ার যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণসহ কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় গত বছরের মতো এ বছরও কুরবানির পশুর চামড়ার একটা বড় অংশ পাচার হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর বাইরের জেলাগুলো থেকেই আসে বিরাট অংশের কাঁচা চামড়া। পরিবহন খরচ মেটানোর ভয়ে সীমান্ত অঞ্চলের চামড়া স্থানীয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভারতে পাচার হয়ে হয়ে যায়। এসব এলাকার জন্য ভারতে চামড়া বিক্রি করা তুলনামূলক সহজ। সূত্র মতে, বিগত কয়েক বছরের বেশি সময় ভারতে গরু জবাইয়ে কড়াকড়ি থাকায় ভারতের ট্যানারিগুলোয় কাঁচা চামড়ার তীব্র সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ভারতের বামতলা, কানপুর, চেন্নাই ও পাঞ্জাবে কয়েক হাজার ট্যানারি আছে। ২০১৪ সালের মে মাসে দেশটি বাংলাদেশে গরু পাচার বন্ধের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে ভারতে গরু জবাই নিষিদ্ধ করে। এতে ট্যানারিগুলোয় কাঁচা চামড়ার সঙ্কট তৈরি হতে থাকে। সম্প্রতি সঙ্কট কাটাতে কাঁচা চামড়া আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। আর এ সুযোগে ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে থাকে চামড়া পাচারকারী চক্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচা চামড়া দেশের মূল্যবান সম্পদ। বছরের এ সময়টিতেই ভালো উন্নতমানের চামড়াগুলো সংগ্রহ করা যায়। কাঁচা চামড়া রফতানিতে কিছু কাঁচা পয়সা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তা চামড়া সেক্টরের জন্য অশনিসঙ্কেত। নতুন ট্যানারি নির্মাণ, ব্যাংক ঋণ পরিশোধ, কাঁচা চামড়া কিনতে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার অনিশ্চয়তার কারণে এ বছরও ভারতে চামড়া পাচারের শঙ্কা করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। গেল বছরের কাঁচা চামড়া কিনতে সরকার ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছিল। এ ঋণের অর্ধেকও পরিশোধ করতে সক্ষম হননি ট্যানারি মালিকরা। গত বছরের ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় নতুন করে এ বছর ঋণ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। এক্ষেত্রে ঋণ পুনঃতফসিলের দাবি জানিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, এমনটি না হলে চামড়া পাচারের আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশের কাঁচা চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম ঈদুল আজহা। গত দুই বছরের মতো এর আগে আমাদের চামড়াশিল্প এমন দুর্দিনে পড়েনি। তাই সরকারি সহায়তা খুবই প্রয়োজন এ সময়টিতে।
চামড়াশিল্পের এই নাটকীয়তা কবে শেষ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা। কুরবানির ঈদের চামড়াগুলোর মূল্য এদেশের গরিব-মিসকিনদের অধিকার। ইসলাম ধর্মে বার বার তাগাদা দেয়া হয়েছেÑ যেন গরিবের হক নষ্ট না করা হয়। কিন্তু কিছু সিন্ডিকেটের হাতে দেশের সমগ্র চামড়াশিল্প বিগত কয়েক বছর ধরে কুক্ষিগত। এদের কারণে দরিদ্র মানুষ তাদের ন্যায্য হক বা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভারতে প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়ার দাম ৮০-১০০ টাকা হলেও বাংলাদেশে মাত্র ২৫-৩০ টাকা। এই বৈষম্য দূর করতে না পারলে পাচার ঠেকানো মুশকিল। সবকিছু বিবেচনা করলে দেখা যায়, ভারতের সাথে আমাদের প্রতি পিস চামড়ার মূল্যে পার্থক্য প্রতি চামড়ায় প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের চামড়ার চাহিদা বেশি। কেননা এ দেশের প্রতিটি পশু জবাই করার পর চামড়া সংগ্রহ করা হয়, যা বৈজ্ঞানিকভাবে খুবই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ভারতে চামড়ার বিশাল একটি অংশ সংগ্রহ করা হয় মৃত গরু থেকে। এতে করে চামড়ার মান খারাপ হয়ে থাকে। তারপরও তাদের চামড়ার মূল্য আমাদের চেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম হলে ভারত বেশি দামে চামড়া বিক্রি করে কীভাবে? সিন্ডিকেট ইচ্ছে করেই এ ধরনের সংকট সৃষ্টি করে নিজ স্বার্থে। এর মধ্যে রয়েছে ট্যানারি মালিকদের সরকারদলীয় মদদপুষ্ট শক্তিশালী সিন্ডেকেট। এছাড়া এ খাত নিয়ে সরকারের পূর্বপ্রস্তুতির অভাব এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা তো রয়েছেই। তবে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, চামড়ার দাম নিয়ে অন্তরালে কেউ কেউ নোংরা খেলা খেলে নিজেরা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন। সরকার ইচ্ছে করলেই এদের চিহ্নিত করতে পারে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৬৫ লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ছাগলের চামড়া ১ কোটি, গরু ৫০ লাখ এবং ভেড়া ও মহিষ মিলে ১৫ লাখ। সব মিলিয়ে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। আর এই চামড়ার প্রায় অর্ধেকই পাওয়া যায় কুরবানি ঈদের সময়। এসব কথা মাথা রেখে চামড়া সংগ্রহের জন্য প্রতি বছর ট্যানারি মালিকদের ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকে সরকার।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) দাবি, ২০১৫ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দরপতন শুরু হয়। ফলে দেশেও এর প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব হোসেন বলেন, ২০১৫ সাল থেকে চামড়ার দাম পড়ে যাচ্ছে। এর আগে এমনটা ঘটেনি। এর প্রধান কারণ ব্যাংক ঋণ আড়তদাররা পান না। ঋণ সবসময় ট্যানারি মালিকরা পেয়ে থাকেন। জানা গেছে, এবারও (২০২০) চামড়া খাতের ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশই খেলাপি হয়ে আছে। এ খাতের উদ্যোক্তারা নতুন করে ঋণ নিতে পারছেন না। এজন্য কুরবানি উপলক্ষে সহজ শর্তে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মাত্র ২ শতাংশ এককালীন জমা দিয়ে চামড়ার ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চামড়া খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ঋণের বড় অংশই সরকারি ব্যাংকের। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ২০১৭ সাল থেকে ট্যানারি স্থানান্তর করতে হচ্ছে। ফলে আমরা সঠিকভাবে উৎপাদনে যেতে পারিনি। আন্তর্জাতিক অনেক মার্কেট আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এছাড়া ব্যাংক থেকে আমাদের সঠিকভাবে ঋণও দিচ্ছে না। এ কারণে ঈদের দিন চামড়া বেচাকেনায় সমস্যাগুলো হচ্ছে। কিন্তু বিগত প্রতি কুরবানির ঈদে পানির দামে বিক্রি হয়ে থাকে কাঁচা চামড়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণভাবে চামড়া ব্যবসায়ী ও চামড়াশিল্পের মালিকদের একটি প্রবণতা থাকে সরকারি ব্যাংক ঋণগুলো খেয়ে ফেলার। তারা অনেকটা স্বজ্ঞানে এ ঋণগুলো খেলাপি করে। ইতোমধ্যে চামড়া খাতে ব্যাংকগুলোর মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকাই খেলাপি। তারা নিজেদের স্বার্থেই এ শিল্পটি নিয়ে খেলছেন। তা সত্ত্বেও চামড়াশিল্প মালিক ও রফতানিকারকরা বাজার মন্দা বলে চামড়া বিক্রেতা পক্ষকে মাত্রাতিরিক্তভাবে ঠকান। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কুরবানির পশুর চামড়ার সঙ্কট উত্তরণ এবং চামড়াশিল্প রক্ষায় গত ২০১৯ সালের অক্টোবরে সরকারের চারটি মন্ত্রণালয় ও বেশ কয়েকটি বিভাগের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় এবারের কুরবানিতেও পশুর চামড়া নিয়ে বিশৃঙ্খলার শঙ্কা করেন সংশ্লিষ্টরা। সভায় কয়েকটি প্রস্তাব ও কিছু সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ছিল ঈদের এক মাস আগে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে ব্যাপকভাবে প্রচার, এক মাস আগে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের জন্য চামড়া কেনার প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় করা, প্রয়োজনে সরকারের বাজার থেকে অবিক্রীত চামড়া কিনে গুদামজাত করা ইত্যাদি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর কোনোটিই আর বাস্তবায়িত হয়নি। ফিনিশড লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি দিলজাহান ভূঁইয়া জানান, এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে এ খাতে ঋণখেলাপিদের ব্যাপারে একটি নীতিমালা করা দরকার। ব্যবসায়ীরা জানান, কুরবানির চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, তৃণমূল পর্যায়ে চামড়ার মূল্য নিশ্চিত করা, ওয়েট-ব্ল চামড়া রফতানি ও কুরবানির সময় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে চামড়া ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয় থাকতে হবে।
ইপিবি সূত্র মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) আট মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি হয়েছে ৬৩ কোটি ১৮ লাখ ডলারের, আগের অর্থবছরে একই সময়ের চেয়ে যা ৯ শতাংশ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আট মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি হয়েছিল ৬৯ কোটি ৪৭।
অর্থনীতিবিদগণ বলছেন, সরকারি অদূরদর্শিতায় বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ রফতানিপণ্য চামড়ার বাজার আজ ধ্বংসের পথে। বর্তমানে দুই-তিন হাজার টাকার একেকটি চামড়ার দাম মুহূর্তের মধ্যে বিগত কয়েক বছরে মাত্র কয়েকশ’ টাকায় নিচে নেমে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়া দিয়ে যেসব পণ্য তৈরি করা হয়, তার প্রত্যেকটির মূল্য প্রতি বছর বেড়েই চলছে। বিশেষ করে জুতা ও চামড়ার ব্যাগ, বেল্ট ও জ্যাকেটের দাম বর্তমানে আকাশচুম্বী। এক জোড়া চামড়ার জুতার দাম যেটি আগে হাজার/বারোশ টাকা ছিল সেটি এখন ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক হাজার টাকা। তাই চামড়ার দাম কোথায় কমেছে। গবেষকরা বলছেন, কাঁচামালের সাথে তৈরি পণ্যের দাম নির্ধারণে একটু পার্থক্য থাকবে। কিন্তু সেটা যৌক্তিক হচ্ছে কি না, এ দেশে সে বিষয়ে কোনো ধরনের নজরদারির কেউ নেই। একসময় দেশীয় চামড়ার বড় ক্রেতা ছিল কোরিয়া, বর্তমানে চীন। সেই চীন চামড়া পাঠায় আমেরিকায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের চামড়া নিচ্ছে চীন, ইতালি, ভারত আবার এরপর বাংলাদেশের কাছেই উচ্চমূল্যে জুতা রফতানি করছে। বাংলাদেশের চামড়া দিয়ে জুতা তৈরি করে চোরাইপথে আসা সেই ভারতীয় জুতায় আবার বাংলাদেশের জুতার বাজার নষ্ট করে দিচ্ছে। ভারতীয় জুতায় বাজার ছেয়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক কারখানা। জুতা উদ্যোক্তারা জানান, পাদুকা কারখানাগুলো বছরে স্থানীয় বাজারে ২৫ কোটি জোড়া জুতা সরবরাহ করে, কিন্তু অবৈধপথে আসা ভারতীয় জুতা দেশের পাইকারি মার্কেটগুলো থেকে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব জুতা আমদানি হওয়ায় সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। বাজারে ভারতীয় ও চায়না জুতার দখলের কারণে বাংলাদেশের জুতাশিল্পও আজ হুমকির সম্মুখীন। রফতানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বিশাল বাজারও হতে পারে কর্মসংস্থান, অর্থনীতি আর বাণিজ্যের বিরাট ক্ষেত্র।

 

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,  গত বছরের মতোই এবারও চামড়ার কদর নেই। এ কারণে পাড়া-মহল্লা থেকে খুবই অল্প দামে চামড়া সংগ্রহ করবেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে রাজধানীর গোপীবাগ এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ী লিটন সরকার বলেন, ‘পরপর গত দুইবার চামড়া কিনে ঠকেছি।’ এ কারণে এবার সবচেয়ে ভালো ও বড় মাপের চামড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কিনবেন। মাঝারি সাইজের চামড়া ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, আর ছোট গরুর চামড়ার দাম পড়বে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বলে জানান তিনি।

শুধু রাজধানীই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও কম দামে এবার কেনার জন্য অপেক্ষা করছেন। এ প্রসঙ্গে পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া উপজেলার মাগুড়া গ্রামের আশরাফুল আলম  জানান, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় চামড়া  কিনবেন। তিনি বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে এক সপ্তাহ আগে থেকে চামড়া কেনার জন্য বলা হতো। মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও সেইভাবে টাকা জোগার করে রাখতো। কিন্তু এবার ঈদ চলে এলো  অথচ পাইকার, আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে চামড়া কেনার ব্যাপারে কোনও নির্দেশনা নেই।’ তিনি বলেন, ‘গত বছর চামড়া কিনে দাম পাইনি। এবার যাতে চামড়া কিনে বিপদে পড়তে না হয়, সে জন্য গড়ে আড়াইশ’ টাকায় চামড়া কিনবো।’

এদিকে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চামড়া কিনলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ঝুঁকিতে পড়বেন না।বরং ঝুঁকিতে থাকবেন ট্যানারি মালিকরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাশে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যবসায় লাভ লোকসান থাকে। এবার হয়তো মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লোকসান করবে না। কিন্তু ঝুঁকিতে থাকবেন ট্যানারি মালিকরা।’  কী কারণে ঝুঁকিতে থাকবেন জানতে চাইলে  তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষ ঘরের মধ্যে বন্দি থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। অধিকাংশ মানুষ এখন অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান— এই তিনটি নিয়ে ভাবছে। জুতা বা চামড়ার পণ্য ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতিতে কেউ নেই। পৃথিবীর নামি-দামি শোরুমগুলো বন্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করবো। কারণ, এ সময়ের সংগৃহীত চামড়া দিয়েই আমাদের সারাবছর কাজ করতে হয়। ফ্যাক্টরি চালু রাখতে হয়। শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়।’

সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয়, আর  নামিদামি শো-রুম যদি না খোলে, তাহলে ট্যানারি মালিকরা লোকসানে পড়বেন। অর্থাৎ সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কেনার পরও এ বছর ট্যানারি মালিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবেন।’  তিনি বলেন, ‘মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যদি চামড়া কিনে বিকালের মধ্যে বা সন্ধার মধ্যে বিক্রি করে দিতে পারেন, তাহলে লোকসান হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। কিন্তু যারা বেশি লাভের আশায় মধ্যরাত পর্যন্ত বসে থাকেন, তারা শেষ পর্যন্ত লাভ করতে পারেন না।’

এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহার জন্য চামড়ার নির্ধারিত দর গত বছরের চেয়ে বেশ কম। এ বছর ঢাকার জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছর ঢাকায় ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর  ঢাকার বাইরে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।

অন্যদিকে খাসির চামড়া সারাদেশে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর খাসির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা ও বকরির চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আর্ন্তজাতিক বাজারেই চামড়ার চাহিদা নেই। এ কারণে এবার সরকারের পক্ষ থেকে চামড়ার দাম ৩০ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এই চামড়ার ওপর নির্ভরশীল গরিব ও দুস্থরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এছাড়া, এবার প্রায় ৪০ শতাংশ কম কোরবানি হবে। ফলে গরিব দুস্থদের আয় এই খাত থেকে ৪০ শতাংশ কম হবে। তবে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই খবরটাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারলে চামড়ার দাম কিছুটা বাড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর এবং তার আগের বছর (২০১৯ ও ২০১৮) চামড়া কিনে বড় বিপদে পড়েছিলেন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। যেসব মৌসুমি ব্যবসায়ী ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় চামড়া কিনেছিলেন, তারাই বিপাকে পড়েছিলেন। শুধু তাই নয়, কয়েক হাজার মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কিনে লোকসান গুনেছেন। অনেকে চামড়া কিনে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন।

ট্যানারিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই চামড়া মূলত আড়তদারের কাছে সংরক্ষিত থাকে। আড়তদার কিছু লাভ রেখে ট্যানারিতে চামড়া পৌঁছে দেন। যদিও ট্যানারি পর্যন্ত পৌঁছানোর খরচও বহন করতে হয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের। ট্যানারির মালিকরা সেই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন পণ্য বানান। এসব পণ্য বিদেশেও রফতানি করা হয়।

প্রসঙ্গত, কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে সারাদেশে কয়েক লাখ মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কেনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। কয়েক হাজার পাইকারি ব্যবসায়ী এই চামড়া তাদের কাছ থেকে কিনে আড়তদারদের কাছে জমা রাখেন।

Check Also

মেজরিটি–মাইনরিটি মানি না, এ দেশের নাগরিক প্রত্যেকে সমমর্যাদাবান: ডা শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা সাফ বলেছি, মেজরিটি-মাইনরিটি মানি না। এ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।