সাতক্ষীরায় ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান: জেল জরিমানা

ক্রাইমবাতা রিপোট: সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরা শহরের বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ব্যাপক প্রত্যারণা ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রভাবশালীরে ছত্র ছায়ায় চিকিৎসা নিতে আসা অসহায় রোগীদের স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। পরীক্ষা নিরিক্ষার নামে কষায় খানা খুলে বসে এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো।
এদিকে আজ সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাতক্ষীরা শহরের বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা সিভিল সার্জান জানান,লাইসেন্স গ্রহণ ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপনের পূর্ব শর্তগুলো পূরণ ব্যতিরেকেই অনেকে ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। উপরিউক্ত অপরাধের দায়ে প্রাইম ডায়াগনস্টিক ও সোনালী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদ্বয়কে মেডিকেল প্র্যাকটিস এবং বেসরকারি ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরি( নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ- ১৯৮২ অনুযায়ী ৫০০০ টাকা করে অর্থ দন্ড ও ১০ দিন করে কারা দন্ড প্রদান করা হয়।মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জনাব নুরুল আমিন এবং প্রসিকিউটর হিসাবে সিভিল সার্জনের প্রতিনিধি ডাঃ জয়ন্ত সরকার উক্ত অভিযানে সহায়তা করেন। জনস্বার্থে এই ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

সূত্র মতে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় সুন্দরবনঘেঁষা একটি জনপদ সাতক্ষীরা জেলা । এ জেলার মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সংগে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে।কিন্তু সুষ্ঠু স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখানকার জনসাধারণ। কারন, বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই সাতক্ষীরায় নামিদামী ডাক্তারের প্রচার চালিয়ে, মাইকিং করে, ও দালাল নিয়োগের মাধ্যমে রমরমা ব্যবসা পরিচালনা করছে শতাধিক বেসরকারি ক্লিনিক ও হসপিটাল। ফলে ওই সকল ক্লিনিক ও তাদের লোকজন দ্বারা প্রতারিত হয়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন সাধারণ রোগী ও তাদের স্বজনরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই সকল বেসরকারি ক্লিনিক বা হসপিটালের লাইসেন্স বা অনলাইন লাইসেন্স নবায়নের কোনো বৈধ কাগজপত্র না থাকলেও আইনের মার প্যাচে প্রকাশ্যে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। যা দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ’৯০ এর দশকে জেলাব্যাপী বেসরকারি ক্লিনিক ব্যবসা শুরু হলেও ২০০৮ সালের পর থেকে তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এভাবে বাড়তে বাড়তে জেলায় এখন ১০০টি বেসরকারি ক্লিনিক বা হসপিটাল গড়ে উঠে। এদিকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশের ক্লিনিকগুলোকে অনলাইন লাইসেন্সের আওতায় আনার কার্যক্রম শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই প্রেক্ষিতে জেলার পর্যায়ের ১৬টি ও উপজেলা পর্যায়ে ১২টি বেসরকারি ক্লিনিক বা হসপিটালের মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানের অনলাইন লাইন্সেস নবায়নের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেছিলেন। এরমধ্যে ২৭টি ক্লিনিককে অনলাইন লাইন্সেস নবায়নের সনদ দেন কর্তৃপক্ষ। এর প্রেক্ষিতে সাতক্ষীরার ২৩টি নিউ ও ৯টি রিনিউ এর জন্য বেসরকারি ক্লিনিক বা হসপিটালের মালিকরা অনলাইন লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেন। এদিকে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ বছরের পর পর রাজস্ব থেকে বঞ্চিত।

সিভিল সার্জন অফিস ও সাতক্ষীরা পৌরসভা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে,
★আশাশুনি উপজেলায় ৩টি- ১)বুধহাটার কুল্যার মোড়ে মা সার্জিকাল ক্লিনিক ২) বুধহাটা বাজারে বাবলা মেমোরিয়াল ক্লিনিক ৩)তেঁতুলিয়া বাজারে আয়ুব আলী ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

★কলারোয়া উপজেলায় ১৯টি- ১)কোল্ড স্টোরেজ মোড়ে সাকিব মেমোরিয়াল ক্লিনিক, ২)হাসপাতাল রোডে মাতৃসেবা ক্লিনিক, ৩)নিউ সার্জিক্যাল ক্লিনিক, কলোরোয়া নাসিং হোম, ৪)শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল, ৫)গয়ড়া বাজারে আছিয়া মেমোরিয়াল ক্লিনিক, ৬)রহিমা নার্সিং হোম, ৭)মায়ের হাসি ক্লিনিক, ৮)সোনাবাড়িয়া বাজারে সীমান্ত নার্সিং হোম, ৯)সোনাবাড়িয়া নার্সিং হোম, ১০)কলারোয়া বাজারে মডার্ণ ক্লিনিক, ১১)পালবাড়ীর মোড়ে জনসেবা ক্লিনিক, ১২)খোর্দ্দ বাজারে খোর্দ্দ সার্জিক্যাল ক্লিনিক, ১৩)সরসকাটি বাজারে পল্লী সেবা ক্লিনিক, ১৪)নাসিমা ক্লিনিক, ১৫)বালিয়াডাঙ্গা বাজারে ডা. আব্দুল হাকিম সার্জিকাল ক্লিনিক, ১৬)কাজিরহাটে জননী ক্লিনিক, ১৭)খাদ্যগুদাম মোড়ে হাফিজা ক্লিনিক ও ১৮)থানা মোড়ে সবুজ ক্লিনিক।

★দেবহাটায় ৬টি- ১)কুলিয়ার আশু মার্কেটের হাবিবা সার্জিকাল ক্লিনিক, ২)পারুলিয়া বাজারে মোমেনা হাসপাতাল প্রা., ৩)সখিপুর পালপাড়ার আহসান উল্লাহ মেডিকেল সেন্টার, ৪)সখিপুর মোড়ে আহছানিয়া ক্লিনিক, ৫)সখিপুর মোড়ে গাজী সার্জিকাল ক্লিনিক, ৬)গাজীর হাট বাজারে ইছামতি নার্সিং হোম।

★কালিগঞ্জে ৯ টি- ১)নলতা শরীফে নলতা হাসপাতাল, ২)নলতা চৌমুহনীতে আহছান উল্লাহ ক্লিনিক, ৩)নারায়নপুরে কালিগঞ্জ সার্জিক্যাল ক্লিনিক, ৪)ডা. মো. হযরত আলী ক্লিনিক, ফুলতলায় ঝরণা ক্লিনিক, ৫)পাউখালীতে এ আলী ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ৬)নাজিমগঞ্জ বাজারে যমুনা ক্লিনিক, ৭)বাজার গ্রামে লাইফ কেয়ার ডিজিটাল ল্যাব এন্ড হাসপাতাল, ৮)মুকুন্দপুরে নাঈম ক্লিনিক।

★তালায় ৮টি- ১)সার্জিকাল ক্লিনিক, ২)মডার্ণ ক্লিনিক, ৩)পাটকেলঘাটায় মৌসুমী ক্লিনিক, ৪)স্বাগতা ক্লিনিক, ৫)ডক্টরস ক্লিনিক, ৬)লোকনাথ নার্সিং হোম, ৭)পাটকেলঘাটা নার্সিং হোম, ৮)পপুলার ক্লিনিক।

★শ্যামনগরে ১৩টি- ১)শ্যামনগর শহরে শ্যামনগর ন্যাশনাল হাসপাতাল, ২)সুন্দরবন এ্যাপোলো হাসপাতাল, ৩)শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়কে এমআরএ ক্লিনিক, ৪)মডার্ণ ক্লিনিক, ৫)দেশ মেডিকেল হাসপাতাল, ৬)পল্লী প্রাইভেট হাসপাতাল, ৭)কামিমাড়ী সড়কে সুন্দরবন নার্সিং হোম, ৮)হায়বাতপুরে জননী নার্সিং হোম, ৯)সেবা নার্সিং হোম, ১০)বঙ্গবন্ধু মার্কেটে নগর প্রাইভেট হাসপাতাল, ১১)নওয়াবেকীতে শামিমা ক্লিনিক, ১২)ফার্নান্দো নবরে হাসপাতাল, ১৩)মুন্সিগঞ্জ আরজি নার্সিং হোম।

★সাতক্ষীরা পৌরসভার অভ্যন্তরে ৪৪টি- ১)পপুলার ক্লিনিক, ২)মেঘনা ক্লিনিক, ৩)পঙ্গু ও জেনারেল হাসপাতাল, ৪)মুক্ত ক্লিনিক স্বদেশ ক্লিনিক, ৫)সততা ক্লিনিক, ৬)এমএমসি হাসপাতাল লি., ৭)ডা. মাসউদ আই কেয়ার এন্ড ফ্যাকো সেন্টার, ৮)এম আলী পলি ক্লিনিক, ৯)সালাফিয়া হাসপাতাল, ১০)স্বপ্ন ক্লিনিক, ১১)পিয়াল নাসিং হোম, ১২)নিরাময় ক্লিনিক, ১৩)শিমুল মেমোরিয়াল ক্লিনিক, ১৪)সাতক্ষীরা চক্ষু ক্লিনিক, ১৫)ফারহান ক্লিনিক, ১৬)পার্লে শিশু ক্লিনিক, ১৭)মনজু মেমোরিয়াল নার্সিং হোম, ১৮)ডা. কিউ এ সিদ্দিকী মেমোরিয়াল ক্লিনিক, ১৯)সাতক্ষীরা ট্রমা এন্ড আর্থোপেডিক কেয়ার সেন্টার, ২০)সুস্থি ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ২১)আনোয়ারা মেমোরিয়াল ক্লিনিক, ২২)এভিএএস সমবায় হাসপাতাল, ২৩)কেয়ার ক্লিনিক, কনসালটেন্ট সার্জিকাল ক্লিনিক, ২৪)উপশম সার্জিক্যাল ক্লিনিক, ২৫)ডা. মাহতাব উদ্দীন মেমোরিয়াল ক্লিনিক, ২৬)আল নূর হাসপাতাল, ২৭)একতা হাসপাতাল, একতা ক্লিনিক, ২৮)নাজমুন ক্লিনিক, ২৯)সাতক্ষীরা চক্ষু হাসপাতাল লি., ৩০)স্বপ্ন ক্লিনিক, ৩১)সুন্দরবন ক্লিনিক, ৩২)সাতক্ষীরা ক্লিনিক, ৩৩)সানজানা নার্সিং হোম এন্ড ক্লিনিক, ৩৪)সিটি ক্লিনিক, ৩৫)রাজু ক্লিনিক, ৩৬)সাতক্ষীরা সার্জিকাল ক্লিনিক, ৩৭)হার্ট ফাউন্ডেশন এন্ড ইনটেনসিভ কেয়ার হসপিটাল, ৩৮)সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক, ৩৯)ফারজানা ক্লিনিক, ৪০)সিবি হসপিটাল লি.,৪১) ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল সাতক্ষীরা লি. নামে চিকিৎসা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

জেলার সচেতন মহল জানান, জেলার স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে অনেক আগে থেকে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। হাসপাতালে আসা রোগীকে দালালদের মাধ্যমে বাইরের ক্লিনিকে পাঠানোর অভিযোগও পুরোনো। এছাড়া যে প্রক্রিয়া ও সক্ষমতায় বেসরকারি ক্লিনিকগুলো চালানোর কথা, সে প্রক্রিয়া ও সক্ষমতার ধারে কাছেও নেই ক্লিনিকগুলো। জেলার ২৩ লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা তাই বারবারই হুমকির মধ্যে ছিল ও এখনো আছে। এসকল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে ধরণের প্রশাসনিক তৎপরতা থাকার কথা, তা বরাবরই উদাসীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। এ ত্রাহী অবস্থা থেকে জেলাবাসিকে উদ্ধার করা আশু আবশ্যক। যখন সারাদেশে স্বাস্থ্য সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধধে শুদ্ধি অভিযান চলছে, সে সময়ে জেলার দু’তৃতীয়াংশ ক্লিনিকগুলোর নুন্যতম বৈধতা নেই, ভাবতেই গাঁ শিউরে ওঠে। জেলাবাসির স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এসমস্ত অবৈধ ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে, এটাই প্রত্যাশিত।

সিভিল সার্জন ডা. হুসাঈন সাফাওয়াত জানান, জেলার অধিকাংশ ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার মাধ্যমে ঐ প্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মচারীরা মাসের পর মাস রোগীদের সাথে প্রতারণা করছে তা সত্য। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত জনবল সংকটের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার মানসিকতা থাকলেও নিতে পারি না। অনলাইন লাইসেন্স এর জন্য বেসরকারি ক্লিনিক বা হসপিটাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেছেন। আমাদেরকে ভিজিট করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠানের তালিকাও দিয়েছেন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি ওই কাজ চলমান রয়েছে। কাজ শেষ না হলে তাদের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।