সিন্ডিকেটে নিত্যপণ্যের বাজার

ক্রাইমবাতা ডেস্করিপোট:  সিন্ডিকেটের কবলে নিত্যপণ্যের বাজার। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানী; সবখানেই এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। এদের কাছে সবাই যেন অসহায়। একবার একটি পণ্যের দাম বাড়লে আশপাশের অন্য পণ্যগুলোরও দাম বেড়ে যায়। আর একবার বাড়লে তা কমার কথা যেন চিন্তাও করা যায় না। এমনকি যারা উৎপাদনের সাথে জড়িত; তাদেরও অনেক সময় চড়া মূল্যে নিজ হাতে উৎপাদিত পণ্য কিনে খেতে হয়। ভোক্তারা বলছেন, বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে দেশে যেসব সংস্থা রয়েছে তারা নিষ্ক্রিয়। যে কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
গত কয়েক দিন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আলু, পেঁয়াজসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামই এখন বেশ চড়া। এর সাথে তরিতরকারিও বিক্রি হচ্ছে উচ্চমূল্যে। চালের দাম মাসখানেক ধরেই বস্তায় ২০০-২৫০ টাকা বেশি। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ কাঁচাবাজারে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সাধারণ ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অনেক কিছুরই দাম বেড়েছে সিন্ডিকেটের কারণে, যা সরকারি সংস্থাগুলোও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
১৮-২০ টাকার আলু হঠাৎ করেই চলতি মাসের শুরুতে ৫০ টাকায় বিক্রি শুরু হয় ভোক্তা পর্যায়ে। এ নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে ১৪ অক্টোবর সরকার আলুর খুচরামূল্য কেজিপ্রতি ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। প্রথম দফায় সরকার তিন পর্যায়ে এই দাম নির্ধারণ করে দেয়। কেজিপ্রতি খুচরা পর্যায়ে ৩০, পাইকারিতে ২৫ ও হিমাগার থেকে ২৩ টাকা। কিন্তু সরকারি এই সিদ্ধান্ত মানেনি ব্যবসায়ীরা। তারা ৫০ টাকাতেই আলু বিক্রি অব্যাহত রাখে। পরে ২০ অক্টোবর সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ব্যবসায়ীদের নিয়ে আবার আলোচনার মাধ্যমে দ্বিতীয় দফায় আলুর দাম নির্ধারণ করে, যা ২১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। ওই দিনের সিদ্ধান্ত মতে আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বৈঠকের প্রথমে কেজিপ্রতি মূল্য খুচরা পর্যায়ে ৩৩ টাকা এবং পাইকারি পর্যায়ে ২৬ টাকা প্রস্তাব করেছিলেন কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ। তবে ব্যবসায়ীদের আবদারের মুখে তা নাকচ হয়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ৩০ টাকা এবং কোল্ডস্টোরেজে ২৭ টাকা দাম প্রস্তাব করা হলে তা গৃহীত হয়। একাধিক সূত্র জানান, মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে কৃষি বিপণন অধিদফতর হার মানে। কিন্তু ওই দামেও স্থির নেই। তারা এখনো ৫০ টাকায়ই আলু বিক্রি করছে। তবে কোনো কোনো বাজারে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখনো পেঁয়াজ ৯০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানিক নগর বাজারের একাধিক ব্যবসায়ীর সাথে গতকাল কথা হলে তারা জানান, এসব পণ্য তাদের আগের কেনা। পাইকারি থেকে তারা বেশি দামে কিনেছেন।
এ দিকে শুধু শহরেই নয়; প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও এখন দিশেহারা। যেসব এলাকায় পণ্য উৎপাদন হয় তারাও এখন ওই সব প্রয়োজনীয় পণ্য চড়া মূল্যে কিনে খাচ্ছেন। আলু উৎপাদনের জন্য মুন্সীগঞ্জ অন্যতম। অথচ মুন্সীগঞ্জের মানুষও এখন ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় আলু কিনছেন। তবে চাষের সাথে যারা জড়িত তারা এই চড়ামূল্যে তেমন লাভবান হচ্ছেন না। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক এবং মধ্যস্বত্বভোগীরাই সুযোগগুলো নিচ্ছে। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান থেকে সাংবাদিক হামিদুল ইসলাম লিংকন বলেছেন, মুন্সীগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা মো: আল মামুন জানিয়েছেন, এবার জেলায় ৩৮ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের পর ১৩ লাখ ৫১ হাজার ১২৯ টন আলু উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টন আলুবীজ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় ৮ লাখ টন আলু বিভিন্নভাবে সংরক্ষণসহ কম মূল্যে বিক্রি করে দেয়া হয়। ৫ লাখ ৫১ হাজার টন আলু সংরক্ষণ করা হয় জেলার ৬৬টি হিমাগারে। এর মধ্যে হিমাগারে সংরক্ষিত ২ লাখ টন আলুর মালিক মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। বাকি ৩ লাখ ৫১ হাজার টন আলু কৃষকের। ঝালকাঠির রাজাপুর থেকে সাংবাদিক এনামুল হক বলেন, গ্রামে চারটি লাউয়ের ডগার মূল্য ৫০ টাকা। পচা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। মানুষ দিশেহারা। চাল কিনবে না সবজি কিনবে, রাস্তাঘাটে বের হলেই মানুষের মুখে ক্ষোভের কথা শোনা যায়। এনামুল বলেন, ৭০ টাকার নিচে ভালো কোনো সবজি নেই। আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৫০ টাকা কেজি।
এ দিকে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য যারা দায়িত্ববান, সরকারের সেই সব সংস্থা অনেকটাই নির্বিকার। এমনকি বাজারের এই অস্থিরতা নিয়ে তারা কথা বলতেও রাজি নয়। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে কথা বললে তারা জানান, এসব নিয়ে কথা বলার এখতিয়ার রয়েছে একমাত্র মহাপরিচালকের। মহাপরিচালকের মোবাইলে ফোন দিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। শীর্ষস্থানীয় আরো এক কর্মকর্তার ফোনে একাধিকবার ফোন দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
কনসাস কনজিউমার সোসাইটি-সিসিএসর নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যে কারণে এরূপ ঘটনা ঘটে আসছে। তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের সাথে যারা জড়িত তাদের মধ্যে সরকারের প্রভাবশালী লোক থাকে। যে কারণে বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো তেমন কিছু করতে পারে না। আর তাদের আন্তরিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ। বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে যেসব সংস্থা আছে তারা জানেন কোন পণ্য কেমন উৎপাদন হয়েছে, কেমন মজুদ আছে, কখন সিন্ডিকেট হবে। সে অনুযায়ী তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে না। যারা এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয় না। গত বছর পেঁয়াজের দাম বাড়ার পর ১৬টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা হয়েছিল। অথচ তাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যে কারণে যখন তারা বুঝতে পেরেছে অপরাধ করেও পার পাওয়া যায় তখন তাদের ইচ্ছেমতো বাজারে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।