দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আঁখ চাষে ধ্বস : দুই দশকে আখের উৎপাদন কমেছে ৯৬ শতাংশ

আবু সাইদ বিশ্বাস: ক্রাইমবাতা রিপোট: সাতক্ষীরা: উৎপাদন খরচ বেশি, জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন করে চিনিকল গড়ে না উঠা ও ভারতীয় চিনি আমদানির কারণে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আঁখ চাষ চরম আকারে হ্রাস পেয়েছে। দুই দশকে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে আখের উৎপাদন কমেছে ৯৬ শতাংশ। আঁখের ভরা মৌসুমে এসব অঞ্চলে আঁখের দেখা নেই বললেই চলে।
সূত্রমতে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অধীনে বর্তমানে দেশে ১৫টি চিনিকল আছে। এগুলোর বার্ষিক মোট উৎপাদন ক্ষমতা দুই লাখ ১০ হাজার টন। আগে এক লাখ টনের বেশি উৎপাদন করতে পারলেও এখন ৬০-৭০ হাজার টনের বেশি উৎপাদন করতে পারে না। প্রতিবছরই তাদের চিনি উৎপাদন কমছে, বিপরীতে বাড়ছে লোকসান। ট্যারিফ কমিশন বলছে, দেশে যে পরিমাণ আখ উৎপাদিত হয়, তার অর্ধেকও চিনিকলগুলো পেলে তাদের উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু আখ চাষিরা দাম কম হওয়ায় এবং বিক্রীত আখের দাম সময়মতো না পাওয়ায় গুড় উৎপাদকদের কাছে আখ বিক্রি করে দেন। ফলে লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না বলেই আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে।
দেশে বছরে ২৩ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়; যার শুধু আমদানি মূল্যই সাত হাজার কোটি টাকা। এসব চিনি কারখানায় পরিশোধন হয়ে যখন বাজারে বিক্রি হয় তখন বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। দেশের শীর্ষ পাঁচটি শিল্পগ্রুপ চিনির এই বিশাল বাজারের বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে।
তথ্য মতে দেশে চিনির চাহিদা বছরে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টন। এর মধ্যে মাত্র ৬০-৮০ হাজার টন চিনি উৎপাদন করছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ১৫টি চিনিকল। বাকি চিনির চাহিদার পুরোটাই জোগান দেয় বেসরকারি পরিশোধন কারখানা। দেশের বেসরকারি শিল্পগ্রুপগুলোর অধীনে কারখানায় পরিশোধন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে বছরে ৩২ লাখ টন। কিন্তু চাহিদা আছে ১৬ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার দ্বিগুণ পরিশোধন সক্ষমতা তৈরি করে রাখা হয়েছে আগেভাগেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডিএ পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছর ২০২০ সালে চিনি আমদানির পরিমাণ দুই লাখ টন কমতে পারে। তাদের হিসাবে ২০২০ সালে বাংলাদেশে চিনি আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে ২২ লাখ ৩০ হাজার টন; ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ২৯ হাজার টন। তবে আগামী বছর ২০২১ সালে দেশে চিনি আমদানি বেড়ে ২৫ লাখ ৩০ হাজার টনে উন্নীত হতে পারে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দুই দশক আগেও এ জেলাতে আখ চাষ হতো ব্যাপক ভাবে। তাদের হিসাব মতে, ১৯৯০ সালে সাতক্ষীরা জেলায় আখ চাষ হয়েছে ৫ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে। ২০০০ সালে আবাদ হয়েছে ৩ হাজার ৯৪৮ হেক্টর। এর পর ২০১০ সালে এ জেলায় আখের আবাদ হয়েছে মাত্র ১৪০ হেক্টর জমিতে।এরপর ২০১৯ সালে জেলায় আখ চাষ হয়েছে মাত্র ১২৯ হেক্টর জমিতে। চলতি মৌসুমেও প্রায় একই অবস্থা।
প্রকৃত পক্ষে আবাদের পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়ে কয়েকগুণ কম। কয়েকজন আঁখ চাষী জানান, আঁখ চাষে দিন দিন ক্ষতি হচ্ছে। তাই আঁখ বাদ দিয়ে তারা অন্য ফসল উৎপাদন করছেন। সাতক্ষীরা তালা, মাগুরা, ইসলামকাটী, কুমিরা, পাটকেলঘাটার সরুলিয়া, খলিষখালী, নগরঘাটা, ধানদিয়ার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে আখ চাষের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। চোখে মেলে সীমিত পরিসরে আঁখ চাষ। আশ্বিন-কার্তিক মাসে মন্দার সময়ে যারা আঁখ কেটে রস বিক্রয় করে সংসার চালায় তারাই বর্তমানে আঁখ চাষ করছে বলে জানা যায়। বাণিজ্যিকভাবে আঁখ চাষ করতে কম দেখা যাচ্ছে কৃষকদের। এরই মধ্যে ভারতে আঁখ উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে চিনি রপ্তানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। আর এজন্য দেশটি প্রতিবেশি বাংলাদেশ ও শ্রীঙ্কাকেই টার্গেট করেছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ২০০০ সালের পর থেকে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহে আখসহ অন্যান্য ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ফলে কৃষি জমিতে ক্রমান্বয়ে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তালা উপজেলার খলিষখালি গ্রামের সৈয়িদ শেখ জানান, তার গ্রামের ৭০-৮০ শতাংশ কৃষক দীর্ঘকাল ধরে আখ চাষ করছেন। তিনিও ৩০-৩৫ বছর আখ উৎপাদন করেছেন। কিন্তু গত ১০-১২ বছর ধরে তিনি আখ চাষ আর করছেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০০০ সালের বন্যা, ২০০৭ সালে সিডর ও ২০০৯ আইলার প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর থেকে আগের মতো আখের ফলন হয় না। ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আখ ক্ষেতে বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। এসব রোগের কোনো প্রতিকার না পেয়ে ফসলটি চাষ করা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, জলবায়ু পরিবর্তন, চিনিকল না থাকা এবং ফসলটি এক বছর মেয়াদি হওয়ায় চাষিরা আগ্রহ হারাচ্ছেন আখ চাষে। যেখানে একই জমিতে বছরে তিনটি ফসল করতে পারে সেখানে এক বছর মেয়াদি আখ চাষ করতে চাচ্ছেন না কৃষকরা। তিনি জানান, মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা রোগের প্রতিকারের জন্য কৃষকদের নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

Please follow and like us:

Check Also

আশাশুনির বদরতলা-ব্যাংদহা সড়কে পল্লী বিদ্যুতের পরিত্যাক্ত খুটির রড: l দুর্ঘটনার শঙ্কা

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান( আশাশুনি) সাতক্ষীরা।। আশাশুনি উপজেলার শোভনালী ইউনিয়নের বদরতলা টু ব্যাংদহা সড়কে পল্লী বিদ্যুতের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।