করোনাভাইরাসের প্রভাব: শিল্প খাতে দীর্ঘ মন্দার শঙ্কা
শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে * মেয়াদি ঋণ বিতরণও মন্দা * শিল্প উৎপাদনে কমেছে প্রবৃদ্ধির হার * সচল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি বন্ধ শিল্প চালু এবং নতুন বিনিয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে : ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
করোনার প্রভাবে দেশের শিল্প খাতে মন্দা চলমান। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ, শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, মধ্যবর্তী শিল্পপণ্য আমদানি কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে এসব পণ্য আমদানির এলসি খোলার হার। শিল্প উৎপাদনও নিম্নমুখী।
ইতোমধ্যে হানা দিয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এর প্রভাবে অনেক দেশে সীমিত আকারে লকডাউন (অবরুদ্ধ অবস্থা) চলছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের শিল্প খাতে আগামী দিনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যার প্রভাব দীর্ঘ হবে-এমন আশঙ্কা অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, করোনা অর্থনীতির সব খাতেই আঘাত করেছে। এর ক্ষত না শুকাতেই আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসছে। এতে ক্ষতি আরও বাড়বে। এ ক্ষতি পোষাতে সচল শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। বন্ধ বা রুগ্ণ শিল্পগুলো চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন বিনিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে মানুষের আয় বাড়ানো সম্ভব হবে। তখনই কেবল শিল্প খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল ১ হাজার ৪৬০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয়েছে ১ হাজার ৩৩০ কোটি ডলার। ওই সময়ে এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ।
গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৩৩৪ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ১৫০ কোটি ডলারের পণ্য। আলোচ্য সময়ে আমদানি কমেছে পৌনে ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে বেশির ভাগই কমেছে শিল্পসংশ্লিষ্ট উপকরণের আমদানি।
গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছে সাড়ে ১৫ শতাংশ, একই সঙ্গে আমদানি কমেছে ৩৯ শতাংশ। অন্যান্য শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। আমদানি কমেছে সাড়ে ১৫ শতাংশের বেশি। নতুন শিল্প স্থাপনের গতি হ্রাস পাওয়ায় যন্ত্রপাতি আমদানি যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে এলসি খোলার হারও।
বিদেশ থেকে মধ্যবর্তী শিল্পপণ্য আমদানি করে সেগুলো দিয়ে পূর্ণাঙ্গ পণ্য তৈরি করা হয়। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন গাড়ি, মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, ফ্রিজসহ নানা পণ্য। এসব পণ্যের এলসি খোলা কমেছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। আমদানি কমেছে সাড়ে ২৩ শতাংশের বেশি।
ফলে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করে সেগুলো দিয়ে পূর্ণাঙ্গ পণ্য তৈরির প্রবণতাও কমেছে। একই সময়ের ব্যবধানে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। এতে চলমান শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতাও কমেছে।
রফতানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির জন্য ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার প্রবণতা জুলাইয়ে কমেছে ১২ শতাংশের বেশি। একই সময়ে আমদানি কমেছে সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি। ফলে রফতানি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, করোনা দেশের অর্থনীতির সব খাতেই আঘাত করেছে। এর প্রভাব ইতোমধ্যে যেমন পড়া শুরু হয়েছে, আগামী দিনে আরও পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে তৈরি পোশাক রফতানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে শিল্পের অন্যান্য কাঁচামালের মধ্যে সুতা ও সিনথেটিক ফাইবারের এলসি খোলা বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে আমদানি কমেছে ১৮ শতাংশের বেশি।
ইয়ার্ন কটন ও সিনথেটিকের এলসি খোলা কমেছে ৯ শতাংশ, আমদানি কমেছে সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি। বস্ত্রশিল্পের কাপড় ও গার্মেন্টের অ্যাকসেসরিজ আমদানির এলসি খোলা কমেছে সাড়ে ২০ শতাংশ, আমদানি কমেছে পৌনে ১৭ শতাংশ।
ওষুধশিল্পের কাঁচামালের এলসি খোলা কমেছে পৌনে ৬ শতাংশ। কারণ করোনায় অন্যান্য রোগের সেবা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ওষুধের চাহিদাও কমেছে। তবে সাধারণ ওষুধ আমদানি বেড়েছে ২৯ শতাংশ। এছাড়া করোনার কারণে ওষুধের এলসি খোলা বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে সোয়া ৪৪ শতাংশ। এর মধ্যে বেশির ভাগই করোনাসংশ্লিষ্ট ওষুধ। ওষুধ উৎপাদনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। করোনায় ওষুধের বিক্রিও কমেছে।
রাসায়নিক শিল্পের অন্যতম উপকরণ তরল রাসায়নিক পদার্থ এবং তৈরি বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য আমদানির এলসি খোলা কমেছে ১০ শতাংশের বেশি, আমদানি কমেছে সাড়ে ৮ শতাংশ। এর মধ্যে রাসায়নিক সার আমদানির এলসি খোলা কমেছে সাড়ে ১৯ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ৬ শতাংশের বেশি।
কয়লা ও পোড়া কয়লা বা কোক আমদানির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৬৮ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে সাড়ে ২৭ শতাংশ। সিমেন্ট আমদানির এলসি খোলা কমেছে সোয়া ৩ শতাংশের বেশি। আমদানি কমেছে ৩৩ শতাংশ। সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিকার বা ঝামা ও চুনাপাথরের এলসি খোলা বেড়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ, আমদানি কমেছে সাড়ে ১৬ শতাংশ। বিভিন্ন ধরনের গ্লাসের এলসি খোলা সাড়ে ৩২ শতাংশ এবং আমদানি সাড়ে ৩৪ শতাংশ কমেছে।
পুরনো জাহাজ আমদানি করে দেশে সেগুলো কেটে রডসহ বিভিন্ন লোহার উপকরণ তৈরি করা হয়। পুরনো জাহাজের এলসি খোলা কমেছে সাড়ে ৪১ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৩২ শতাংশ। পেপার ও পেপার বোর্ড আমদানির এলসি খোলা কমেছে সোয়া ২৩ শতাংশ, আমদানি কমেছে সোয়া ১০ শতাংশ।
এ বিষয়ে বেসরকারি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, কিছু খাতে আমদানি বা এলসি খোলা বাড়লেও তা প্রত্যাশিত নয়। কেননা বিভিন্ন খাতে বিকাশ হচ্ছে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে। সে হারে এলসি খোলা বা আমদানি বাড়ছে না। তবে কিছু পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমায় আমদানি ব্যয় কমেছে। এতে আমদানি বাড়ার কথা। বাস্তবে তা হয়নি। বরং উদ্যোক্তাদের এলসি খোলার প্রবণতা কমে গেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল আমদানির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশ। এর দামে ভয়াবহ পতন হওয়ায় দাম ব্যয় কমেছে। এছাড়া করোনার কারণে প্রায় তিন মাস যানবাহন বন্ধ থাকায় এর চাহিদা কমেছে।
গত বছরের জুলায়ের তুলনায় এ বছরের জুলাইয়ে শিল্প উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। অন্যান্য সময় এ প্রবৃদ্ধি ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হয়ে থাকে।
অন্যান্য পণ্য আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে সোয়া ৪ শতাংশ। আমদানির কমেছে সোয়া ৫ শতাংশ।
নতুন শিল্প তৈরির অন্যতম উপকরণ হচ্ছে পুঁজি বিনিয়োগ। উদ্যোক্তা ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করলে ব্যাংক ঋণ দেয় ৭০ শতাংশ। উদ্যোক্তা ও শিল্পের ঝুঁকি বিবেচনায় এ হার কমবেশি হয়ে থাকে। উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ ও ব্যাংক ঋণেও মন্দা বিরাজ করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ বেড়েছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। অক্টোবর-ডিসেম্বরে কমেছে শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। জানুয়ারি-মার্চে বেড়েছিল সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি। একদিকে করোনার থাবা শুরুর পর এপ্রিল-জুনে মেয়াদি ঋণ কমেছে সাড়ে ৪৫ শতাংশ।
অর্থাৎ দুই প্রান্তিকে বেড়েছিল ১৯ শতাংশ। এক প্রান্তিকেই কমেছে সাড়ে ৪৫ শতাংশ। তবে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ বিতরণ গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বেড়েছে পৌনে ১১ শতাংশ।
গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছিল ১৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে এফডিআর কমেছে ৬০ শতাংশ।
গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে নতুন বিনিয়োগ তো বাড়েইনি, উল্টো আগের বিনিয়োগ তুলে নেয়া হয়েছে ১৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
বৈদেশিক ঋণ বাবদ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ৭২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন বিনিয়োগ আসেনি। উল্টো কমেছে ৭১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এসব শিল্প খাতে পুঁজির প্রবাহ কমেছে।
গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে বিনিয়োগ তো বাড়েইনি, উল্টো আরও কমেছে ১৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
ঋণ বাবদ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ৭২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন বিনিয়োগ আসেনি। উল্টো কমেছে ৭১ কোটি ৩০ লাখ ডলার।jugantor