কালোদের অধিকারে বছর কয়েক আগে আমেরিকায় ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন শুরু হলেও চলতি বছরে তা আন্তর্জাতিকভাবে সবার মনোযোগ কেড়েছে।
গত ২৬ মে মিনিয়াপোলিসে পুলিশ কর্মকর্তারা জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গের ঘাড়ে হাঁটু চেপে হত্যা করলে দেশটিতে বিক্ষোভের ঢল নামে।
নিহত হওয়ার আগে ফ্লয়েড অনুনয় করে বলেছিলেন– ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ এই ছবি সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দুনিয়ার মানুষকে নাড়া দিয়েছে। পরে তার এই আকুতিকে স্লোগানে পরিণত করে মানুষ রাজপথে নেমে আসেন।
এ বছরের ব্ল্যাকলাইভ ম্যাটার আন্দোলনে দেড় কোটি থেকে আড়াই কোটি প্রতিবাদকারী অংশ নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এ যাবতকালের বড় ঘটনাগুলোর মধ্যে যা অন্যতম।
এ আন্দোলনে পুলিশের তহবিল কমিয়ে দেয়া এবং কালো মানুষদের উন্নয়নে সরাসরি বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।
কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি পুলিশি নৃশংসতা বর্ণবাদী সহিংসতার প্রতিবাদে অহিংসভাবে আইন অমান্য করতে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস (বিএলএম)। বিভিন্ন ধরনের মানুষ ও সংগঠন নিয়ে এ আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ স্লোগান কোনো একটি একক গোষ্ঠীর না। বিস্তৃত পরিসরের এ আন্দোলন কেবল কালো মানুষদের প্রতি পুলিশি সহিংসতার প্রতিবাদেই হয়ে আসছে। এছাড়া কালোদের মুক্তি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নীতিতে পরিবর্তনের বিষয়টি সামনে রেখে এ আন্দোলন।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আফ্রিকান-আমেরিকান কিশোর ট্রেইভন মার্টিনকে গুলি করে হত্যার সতেরো মাস পর জর্জ জিমারম্যানকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
১৭ বছর বয়সী এই কিশোর দোকান থেকে মিষ্টি ও বরফ চা কিনে ফিরছিল। জিমারম্যানের দাবি, এই কালো কিশোরকে তার কাছে সন্দেহজনক বলে মনে হয়েছে। যে কারণে তাকে গুলি করে হত্যা করলেন তিনি।
এর পরপরই ২০১৩ সালের জুলাইয়ে সামাজিকমাধ্যমে ‘হ্যাশট্যাগ ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আন্দোলন। পরবর্তীতে তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
২০১৪ সালে আরও দুই আফ্রিকান-আমেরিকানকে গুলি করে হত্যার পর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। পুলিশ কর্মকর্তা ড্যারেন উইলসনের গুলিতে নিহত হয়েছেন মাইকেল ব্লাউন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ।
সেন্ট লুইসের কাছে মিসৌরির ফার্গুসন শহরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কারণ এখানেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। এ হত্যাকাণ্ডের পর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন সময় পুলিশের গুলিতে ও হেফাজতে আফ্রিকান-আমেরিকান নিহত হওয়ার প্রতিবাদ জানান। পরে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জড়িয়ে পড়েন ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকারীরা।
সবার আগে এই হ্যাশট্যাগ আন্দোলন শুরু করেছিলেন মার্কিন মানবাধিকারকর্মী অ্যালিসিয়া গারজা, প্যাট্রিস কেলোরস ও ওপাল টোমেটি। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তারা নিজেদের প্রকল্প সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার মূলত কোনো আনুষ্ঠানিক পদবিন্যাস ছাড়া একটি বিকেন্দ্রীভূত আন্দোলনের নেটওয়ার্ক।
সময় যত যাচ্ছে এ আন্দোলনের জনপ্রিয়তা ততই বাড়ছে। যদিও বছর দুয়েক আগে জনপ্রিয়তা পড়তির দিকে ছিল। কিন্তু ২০১৯ ও ২০২০ সালে তা বাড়তির দিকে রয়েছে।
গত জুনে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে বলা হয়, ৬৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান এ আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু সেপ্টেম্বরের এক জরিপ বলছে,সেই জনপ্রিয়তা কমে ৫৫ শতাংশে নেমেছে।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার পরিভাষাটিকে একটি টুইটার হ্যাশট্যাগ,স্লোগান বা সামাজিক আন্দোলন হিসেবে পরিচিত দেয়া যায়। জাতিগত ন্যায়বিচারের জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর একটি বাঁধনমুক্ত সংঘ হলো এটি।
আন্দোলন হিসেবে এটি বিকেন্দ্রীভূত ও তৃণমূল পর্যায়ের। জাতীয় নেতৃত্বের চেয়ে স্থানীয়ভাবে সংঘটিত হওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন এ আন্দোলনের নেতারা।
এসব দিক বিবেচনায় নিলে সিভিল রাইটস মুভমেন্টসহ আগেরগুলোর চেয়ে বর্তমান আন্দোলন সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রভাববিস্তারের ক্ষেত্রেও বেশি সফল। বর্তমানে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের অধীনে বেশ কয়েকটি বড় সংগঠন ও কর্মীদের নিয়ে একটি বড় আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
এর আগে ২০১৫ সালে পুলিশি নৃশংসতার অবসান ঘটাতে পুলিশের সংস্কারে ‘ক্যাম্পেইন জিরো’ শুরু করেছিলেন জোহনেত্তা এলজি,ডিরেই ম্যাকেসন, ব্রিটানি প্যাকনেট ও স্যামুয়েল সিয়াংগাই। পুলিশের সংস্কারে তারা দশ দফা পরিকল্পনা দিয়েছিল।
এছাড়া নারীবাদ,অভিবাসন ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সক্রিয় ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আহমদ আরবেরি নামের ২৫ বছর বয়সী এক আফ্রিকান-আমেরিকানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সকালে তিনি জগিংয়ে বের হলে তিন সশস্ত্র শ্বেতাঙ্গ অধিবাসী তাকে ধাওয়া করে,যাদের মধ্যে বাবা-ছেলেও ছিল।
আর ১৩ মার্চ আফ্রিকান-আমেরিকান ব্রিওয়ান্না টেইলরের বাড়িতে কড়া নাড়েন লুইসভেলির পুলিশ কর্মকর্তারা। তার বিরুদ্ধে মাদক সংক্রান্ত অভিযোগ ছিল। পুলিশ কয়েক দফায় গুলি করে তাকে হত্যা করেছে।
২৬ বছর বয়সী ব্রিওয়ান্নার ছেলেবন্ধুও ঘটনাস্থলে ছিলেন। তিনি ৯১১ নম্বরে কল দিয়ে বলেন–‘কেউ দরজায় লাথি মারছে এবং আমার মেয়েবন্ধুকে গুলি করছে।’
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় লুইসভ্যালিতে পুলিশের সংস্কারের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে।
২৫ মে নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে ক্রিস্টিয়ান কুপার নামের একজন কালো পাখি-পর্যবেক্ষণকারী এক শ্বেতাঙ্গ নারীর মুখোমুখি হন। তিনি ওই নারীকে বলেছিলেন, যাতে তার কুকুরটি বেঁধে রাখা হয়। এরপর ওই শ্বেতাঙ্গ নারী পুলিশকে ফোন দিয়ে বলেন,‘এক আফ্রিকান-আমেরিকান তাকে হুমকি দিচ্ছেন।’ পরে ওই নারীর বিরুদ্ধে ‘ মিথ্যা অভিযোগ’ করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
নিজেদের ওয়েবসাইটে ব্ল্যাকলাইভস ম্যাটার বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডাসহ এটি একটি বৈশ্বিক সংগঠন। সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের ইতি ঘটিয়ে ও কালো মানুষদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতা বন্ধে স্থানীয় ক্ষমতা তৈরি করাই যার মূল লক্ষ্য।
‘এছাড়া সহিংস কর্মকাণ্ড বন্ধের মাধ্যমে কালোদের সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি করা এবং তাদের জীবমানের উন্নয়ন করার বিষয়টিও আছে।’
সবার অংশগ্রহণে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনে বিশ্বাস করে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার।
তারা জানায়– আমরা মনে করি, জয়ী হতে ও আরও বেশি মানুষকে যুক্ত করতে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বাইরে গিয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে। আমরা এমন একটি আন্দোলন চাই, যাতে সবার অধিকারের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের সঙ্গে তার নেতৃত্বের চেয়েও আক্রান্তদের নামগুলোই বেশি জড়িত। যাদের মধ্যে জর্জ ফ্লয়েড, ব্রিওন্না টেইলর, এরিক গারনার ও মাইকেল ব্রাউন আছেন।
আন্দোলনটির প্রথম ‘অধ্যায়ের’ সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ও লস অ্যাঞ্জেলেসের প্যান আফ্রিকান শিক্ষার অধ্যাপক মেলিন আবদুল্লাহ বলেন, বছর সাতেক আগে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ডাক দিয়েছিলাম। প্রিয় বন্ধু প্যাট্রিস কুলোরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কালো শিল্প সম্প্রদায়ের মধ্যে ৩০ জন আদালত চত্বরে দাঁড়িয়েছিলাম।
‘শিল্পী, সংগঠক ও মায়েরা সেদিন প্রতিবাদ জানান। আমরা জানি, প্রতিবাদ তীব্রতর করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। এটি এমন এক দুঃসাহস, যা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে।’
জর্জ ফ্লয়েড হত্যার শিকার হওয়ার পর এ আন্দোলন এমন এক চূড়ায় পৌঁছায়, যা আগে কখনো ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপে আন্দোলনটি ছড়িয়ে পড়ে।