নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবন। বিশ্বের সেরা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সুন্দরবনের কেওড়া ফল উপকূলীয় মানুষের জন্য খুবই উপকারী। উপকূলবাসী ছাড়াও সহজলভ্য এ ফল যেকোনো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য কয়েকটি ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম। এ তথ্য দিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. শেখ জুলফিকার হোসেন।
সুন্দরবনের কেওড়া ফল নিয়ে গবেষণা বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা কর্মের ভূমিকায় তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এসব ঝুঁকির অন্যতম হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর মিঠা পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়া। এর ফলে বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও নদ-নদীতে সমুদ্রের পানি ঢুকে লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে। এ সমস্যার সমাধান অথবা এর সাথে খাপ খাওয়ানোর উপায় খুঁজে বের করে কাজে লাগানো আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের জন্য জরুরি। কেওড়া গাছ প্রচুর জন্মে। তা ছাড়া নতুন সৃষ্ট চরে এ ম্যানগ্রোভ গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে। লবণসহিষ্ণু এ গাছে প্রচুর ফল হয়, যা কেওড়া ফল হিসেবে পরিচিত। সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় জেলাগুলোর লোকজন কেওড়া ফলের সাথে ছোট চিংড়ি মাছ ও মসুরের ডাল রান্না করে খায়। তা ছাড়া কেওড়া ফল দিয়ে আচার ও চাটনি তৈরি হয়। এ ফল পেটের অসুখের চিকিৎসায় বিশেষত, বদ হজমে ব্যবহৃত হয়। অন্য দিকে, সুন্দরবনের মধুর একটা বড় অংশ আসে কেওড়া ফুল থেকে। এ গাছটি উপকূলীয় মাটির ক্ষয়রোধ করে। এ ছাড়া মাটিকে দেয় দৃঢ়তা ও উর্বরতা। এ গাছটি মাটি রক্ষা এবং লবণাক্ত পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
ড. শেখ জুলফিকার হোসেনের গবেষণা থেকে জানা যায়, কেওড়া ফলে ১২ ভাগ শর্করা, চার ভাগ আমিষ, ১.৫ ভাগ ফ্যাট, প্রচুর ভিটামিন বিশেষত ভিটামিন সি এবং এর ডেরিভেটিভগুলো রয়েছে। কেওড়া ফল পলিফেলন, ফ্লাভানয়েড, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট আনস্যাচুরেটেড মেগা ফ্যাটি এসিড বিশেষ করে লিনোলেয়িক এসিডে পরিপূর্ণ। তাই মনে করা হয়, ফলটি শরীর-মন সতেজ রাখার সাথে সাথে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। চায়ে বিভিন্ন ধরনের পলিফেলন প্রচুর রয়েছে। এ দেশে ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলিফেলন রয়েছে আমলকীতে, তারপর হলো কেওড়া ফলের অবস্থান। কেওড়া ফলে সমপরিমাণ আপেল ও কমলা ফলের তুলনায় অনেক বেশি পলিফেলন ও পুষ্টি উপাদান রয়েছে।
পলিফেলন শরীরে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ, অ্যালার্জি, বিভিন্ন ধরনের প্রদাহসহ প্রভৃতি রোগ সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করে। ফলটিতে আমলকী, আপেল ও কমলার তুলনায় বেশি পরিমাণ পটাশিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম ও জিঙ্ক রয়েছে। এ ফলে রয়েছে ডায়রিয়া ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধী এবং ব্যথানাশক গুণাগুণ। এ ফল ডায়রিয়া, আমাশয় ও পেটের পীড়ার জন্য দায়ী ব্যাক্টেরিয়াকে কার্যকরভাবে দমন করতে পারে। এ ছাড়া কেওড়া ফলে রয়েছে প্রচুর পালমেটিক অ্যাসিড, অ্যাস্করবাইল পালমিটেট ও স্টিয়ারিক অ্যাসিড, যা খাদ্য শিল্পে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে এবং তৈরি খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। তাই উপকূলীয় এলাকায় অনাবাদি লবণাক্ত জমিতে ফলটি ব্যাপকভাবে জন্মানোর উদ্যোগ নিলে প্রান্তিক জনগণের বাড়তি আয়ের উৎস হবে। পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে এবং উপকূলীয় এলাকার গুণগত মানের উন্নয়ন হবে বলে ড. শেখ জুলফিকার হোসেন মনে করেন।
বাংলাদেশে উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার। নদীর মোহনা ছোট বড় দ্বীপমালা ২৭৫ কিলোমিটার, সমতল ও সমুদ্রসৈকত ৩১০ কিলোমিটার। টেকনাফের মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল কালন্দি পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত। দেশের ২৫ শতাংশ জনগণ উপকূল এলাকায় বসবাস করে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান এ অঞ্চলেরই। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সত্ত্বেও এ অঞ্চল, এর অবকাঠমো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানা দৈবদুর্বিপাক, বৈষম্য ও অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল বিরূপ আচরণের শিকার সবসময়ই। কৃষিপ্রধান উপকূলীয় এলাকার অর্থনীতির সুরতহাল রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে এটা প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, জাতীয় অর্থনীতির অন্তঃলীলা শক্তির উদ্বোধন যার হাতে সেই সুন্দরবন বেদনায় বিবর্ণ।
একটি পরিশীলিত সমীক্ষা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যবর্তী মাত্র ১৩ বছরে জাতীয় পর্যায়ে যেখানে দ্বিগুণ পরিমাণ শস্য (খাদ্য অর্থকরী ফসল) উৎপাদিত হয়েছে। সেখানে উপকূলীয় এলাকায় শস্য উৎপাদন বাড়েনি বরং কমেছে। ফারাক্কার উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানে চাষাবাদযোগ্য জমি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়ে কাক্সিক্ষত ফল ততটা আসেনি। সাম্প্রতিককালে সিডর আইলায় সুন্দরবন এবং অনন্য সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার মানুষ অন্যান্য প্রাণীর সম্পদের ওপর দুর্বিষহ ও নেতিবাচক প্রভাব প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। তাতে উপকূলীয় কৃষি অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ দেখা দিয়েছে। ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সুন্দরবন ধ্বংসের মুখে।
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে। চোরা শিকারির হাতে বিশ্বের বিরল প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রতিনিয়ত নিধন হচ্ছে। সুন্দরবনের গণ্ডার বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগে। শূকর, কুমির কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। অজগর, হাঙ্গর, বন মোরগ, বহু রকমের পাখি, মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উজাড় হচ্ছে বন। আগের মতো বড় বড় গাছপালা এখন আর দেখা যায় না। এদিকে সুন্দরবনসংলগ্ন বহু নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। একেবারে মরে গেছে। এদিকে জোয়ারের পানি উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সুন্দরবনের গাছপালা মরে যাচ্ছে। এ বনের ভূপৃষ্ঠ থেকে সমুদ্রতল বেশি নিচুতে নয়। জোয়ারের সময় ৪৫ সেন্টিমিটার পানি বাড়লে সুন্দরবন পৃষ্ঠ ৭৫ শতাংশ ডুবে যাচ্ছে।
উপকূলীয় এলাকা এখন অরক্ষিত। বিশেষ করে টেকসই বাঁধ না থাকায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। প্রতি বছর উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে নদীর পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, পটুয়াখালী, কক্সবাজার, ভোলা অন্যতম। প্রায় ডজনখানেক জেলার ভৌগোলিক অবস্থান উপকূলীয় এলাকায়। এসব উপকূলীয় এলাকা জেলে, কৃষক, বাওয়ালি, কামার, কুমারসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোক বসবাস করে। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূলীয় অধিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশেষ করে মৎস্যসম্পদ আহরণ করে দেশের মৎস্যসম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ চাহিদা পূরণ করে উপকূলীয় জেলেরা।
সাগরসহ স্থানীয় নদ-নদী থেকে মৎস্য সম্পদ আহরণ করে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। বিশেষ করে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করে বাংলাদেশ কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এ পেশার সাথে উপকূলীয় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত। মৎসসম্পদ উৎপাদনের পাশাপাশি প্রচুর বিভিন্ন প্রজাতির ফসল উৎপাদন হয়। যা দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। কিন্তু উপকূলীয় বাঁধগুলো এত জরাজীর্ণ যে এসব এলাকার কোটি কোটি মানুষ চরম আতঙ্ক উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। শুধু সাতক্ষীরা, খুলনা উপকূলীয় এলাকায় সাড়ে ৮ শ’ কিলোমিটার ওয়াপদা বাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। যেকোনো মুহূর্তে এসব বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
সুন্দরবনের ভেতরের জাহাজসহ নানা রকম নৌযানের মেশিনের শব্দ রাতের বেলা সেগুলোর আলো এবং এর সার্সলাইট বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক পরিবেশকে বিঘœ ঘটায়। সিমেন্ট কারখানাসহ বড় ধরনের কারখানা গড়ে উঠেছে মংলায়। সেগুলো পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে চলেছে নীরবে। মোট কথা, গোটা পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। এ গেল বন্দরের স্বাভাবিক অবস্থার কথা, দুর্ঘটনার বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি। বনের ভেতর চলাচলকারী রাসায়নিকবাহী জাহাজ বা বন্দরের আশপাশ এলাকার কারখানার দুর্ঘটনা ঘটলে তা বনের জন্য কতটা বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে সে হিসাব কারো জানা নেই। ২০০ বা ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ চাঁদ সওদাগর এই এলাকায় একটি নগর গড়ে তোলেন। বাগমারা ফরেস্ট অফিসে তার সন্ধ্যান মিলেছে। সুন্দরবনের জরিপটি হয় মহামতি আকবরের সময়ে চৌতক মলের নেতৃত্বে। মনে রাখা দরকার, সুন্দরবনের বিশাল গভীর নদ-নদীআকীর্ণ জঙ্গলে জরিপ সে আমলে প্রায় অসম্ভব ছিল।
অবশ্য সম্রাট আকবর নিজেই এ বন দেখতে এসেছিলেন। এর রূপ তাকে মু গ্ধ করেছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ পরাজয়ের পর নবাবের আসনে আসীন হয়ে মীর জাফর বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিস্তীর্ণ এলাকা দিয়ে ছিলেন। তার ভেতর সুন্দরবনের একটি বড় অংশ ছিল। সুন্দরবনের অফুরন্ত সম্পদ কোম্পানিদের বড় কর্তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই কোম্পানির পক্ষ থেকে ১৮১১সালে শুরু হয় এ বনের জরিপ। কোম্পানির আমলে সুন্দর বনের জমি কৃষকদের মাঝে বিলি বণ্টন করে এই বন সাফ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে থেকে সুন্দরবনে অস্তিত্ব সঙ্কট শুরু হয়। গোট সুন্দর বন এখন বন্যদস্যুদের কবলে। বনের মধ্যে প্রায় আট লাখ পেশাজীবী জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। জেলে বাওয়ালি, মৌয়ালি তাদের কাছ থেকে মাসোহারাভিত্তিক টাকা আদায় করা হচ্ছে। নিয়মিত চাঁদা না দিলে নির্বিঘেœ তাদের হত্যা করা হচ্ছে। এদের হাতে এক যুগে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার।
লেখক : সাংবাদিক