সাতক্ষীরাসহ খুলনা বিভাগে প্রতি সাড়ে ৪ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একটি আইসিইউ!

খুলনা অফিস : খুলনা বিভাগে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে দেখা দিয়েছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সংকটও। হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ বেড খালি নেই।

খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর ও মেহেরপুরে মাত্র ২৩টি আইসিইউ শয্যা আছে। যার মধ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ডেডিকেটেট হাসপাতাল) ১০টি শয্যা, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আটটি, যশোর হাসপাতালে তিনটি ও মেহেরপুরে দু’টি আইসিইউ শয্যা আছে।

সবশেষ আদম শুমারি অনুযায়ী, খুলনাসহ বিভাগের ১০ জেলার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫৭ লাখ। সব মিলিয়ে এ বিভাগে আইসিইউ রয়েছে ২৩টি। অর্থাৎ প্রতি ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৫৬৫ জনের বিপরীতে রয়েছে একটি করে আইসিইউ শয্যা।

শয্যা সংখ্যার চিত্র যতটা ভয়াবহ তার চেয়ে আরও বেশি ভয়াবহ আইসিইউ পরিচালনার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকায় থাকা অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসকদের। তিন জেলার সরকারি হাসপাতালে রয়েছেন মাত্র তিনজন।

সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যখন এই দুরাবস্থা তখন বিভাগের বেসরকারি তিন হাসপাতালে অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয় রোগীর স্বজনদের দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানা যায়, বিভাগের খুলনা, সাতক্ষীরা ও মেহেরপুরে আইসিইউ সুবিধা রয়েছে। গত বছরে খুলনা বিভাগের একমাত্র করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১০টি বেডের আইসিইউ সেবা চালু করা হয়। এছাড়া হাসপাতালে আরও ২০টি শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন, ভেন্টিলেশন সাপোর্ট আর হাই ফ্লো নজেল ক্যানোলার ব্যবস্থা না হওয়ায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। ফলে বিভাগে আইসিইউর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

এদিকে বিভাগের ১০ জেলায় বেসরকারিভাবে করোনা রোগীদের জন্য খুলনার গাজী মেডিকেল, সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সাতক্ষীরার সিবি হাসপাতালে শয্যা রয়েছে পাঁচটি করে। তবে সেখানে প্রধান অন্তরায় নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন।

অভিযোগ রয়েছে, করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীরা আইসিইউর সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্তহীনতায় কারণে।

খুলনা ব্লাড ব্যাংকের অর্থ সম্পাদক মো. আসাদ শেখ বলেন, হঠাৎ রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হলে আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। কিন্তু হাসপাতালগুলোয় আইসিইউর জন্য হাহাকার। ২০ শতাংশ করোনা রোগী হঠ্যাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের জন্য আইসিইউ প্রয়োজন হলেও পাওয়া যায় না। যে হারে করোনা রোগী বাড়ছে সে হারে আইসিইউ সেবা না বাড়লে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

করোনা পরিস্থিতি এবং আইসিইউ সংকট নিয়ে কথা হয় খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা সঙ্গে। তিনি বলেন, করোনায় এ পর্যন্ত খুলনা বিভাগে ৫২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিভাগে ২৩টি আইসিইউ আছে। যা দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও নড়াইলে আইসিউ সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। বাগেরহাট সদর হাসপাতালেও আইসিইউ  স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।  এদিকে রোববার (১৮ এপ্রিল) খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এদিন খুমেকের পিসিআর ল্যাবে ৬৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

খুলনা মেডিকেলের করোনা ইউনিট সূত্রে জানা যায়, রোববার রাত সাড়ে ৯ টার দিকে খুমেকের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুপ্রিয়া সাহা (৫৫) নামের এক রোগির মৃত্যু হয়েছে। তিনি কুষ্টিয়া সদরের বারাজি এলাকার অনন্ত সাহার স্ত্রী। ১৭ এপ্রিল করোনা তিনি খুমেকের করোনা ইউনিটে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ রাতে তার মৃত্যু হয়। এর আগে, রোববার দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে এখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গোলাম মোস্তফা (৬৫) নামের আরেক রোগির মৃত্যু হয়। তিনি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার হরিপুর এলাকার আবু তাহের সরদারের ছেলে। সকালে তিনি খুলনা মেডিকেলের করোনা ইউনিটে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুরে মারা যান। এ নিয়ে খুমেকের করোনা ইউনিটে ২০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে রোববার রাতে খুমেক পিসিআর ল্যাবের পরীক্ষায় একদিনে ৬৮ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপাধ্যক্ষ ডা. মেহেদী নেওয়াজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুমেকের পিসিআর মেশিনে ২৮২ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়। এরমধ্যে ৬৮ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে। যার মধ্যে খুলনা মহানগরী ও জেলার ৬১ জন রয়েছে। এছাড়া বাগেরহাটের ৩ জন, যশোর একজন, নড়াইলের একজন, বরিশালের একজন ও ঢাকা জেলার একজন রয়েছে।

এদিকে খুমেক হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৬৯ জন, মারা গেছেন ১১ জন। এছাড়া একই সময়ে আইসোলেশনে ভর্তি হয়েছেন ৮৭ জন এবং মারা গেছেন ৯ জন। গত ২৪ ঘন্টায় খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭৭ জন। এর মধ্যে খুলনা জেলায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫০ জন এর মধ্যে ১ জন রোগী মারা গেছেন। খুলনা জেলায় করোনা শনাক্তের হার ১২ শতাংশ। খুলনা জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির এপ্রিল মাসের সভা রোববার সকালে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে জুম প্রযুক্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ এ তথ্য তুলে ধরেন।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এটিএম মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, খুমেক হাসপাতালে বর্তমানে ইউওলো জোন ও রেড জোন এবং আইসিইউ মিলে মোট ১০০ টি কোরানার শয্যা রয়েছে। দিনকে দিন করোনা রোগী কুাক্ত ও মৃত্যু সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করো আরো করোনার ৫০ শয্যা ও ৩০ টি আইসিইউ বেড চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ওই সব ইউনিট প্রস্তুতির জন্য শ্রমিকরা কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ওই ইউনিটগুলো প্রস্তুতি হলেই সেখানে নতুন করে নার্স, চিকিৎসক ও জনবল প্রয়োজন হবে। এমনতি জনবল সংকট রয়েছে হাসপাতালে। তারপরেও আমরা জনবল সংকটের মধ্যে দিয়ে রেগীদের স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

২০২০ সালের ১০ মার্চ থেকে খুলনায় করোনা পরীক্ষার হিসাব রাখা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ৫শ’ ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনার এ মহামারিতে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু খুলনায়। খুলনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১৩৩ জন। সবচেয়ে কম মৃত্যু মেহেরপুরে। ঐ জেলায় এ পর্যন্ত মারা গেছে ১৭ জন। এছাড়া মৃত্যুর দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কুষ্টিয়া ১শ’ জন। পর্যায়ক্রমে যশোর ৬৮, ঝিনাইদহে ৪৯, চুয়াডাঙ্গা ৪৮, সাতক্ষীরা ৩৭, বাগেরহাট ৩০, মাগুরা ২২ ও নড়াইল ২১ ।

খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক রাশেদা সুলতানা জানান, এ পর্যন্ত খুলনা বিভাগে মোট করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২৯ হাজার ৯শ’ ৯০ জন। সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন ২৬ হাজার ২শ’ ৮১ জন। বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৩ হাজার ৫শ’ ৭২ জন।

Check Also

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ দেবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সচিবালয় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।