রক্ত-ঘামে আজকের উন্নত অর্থনীতির বাংলাদেশ, হাজারো প্রাসাদ, নগর-ভবন, মালিকের আয়েশী জীবন, সেই শ্রমিক-ই বঞ্চনার শিকার হয়। শ্রমিককেই ঠকানো হয়, তাদের শ্রমের প্রকৃত মূল্য দেয়া হয় না। আজকের করনো অতিমারিতেও আমার সেই শ্রমিক, মেহনতি মানুষ পেটের ক্ষুধায় কাতর। ওদিকে শিল্পপতি-পুজিঁপতিরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, তাদের ইশারায় কিছু অতিউৎসাহী পুলিশ সদস্যের বন্দুকের গুলিতে প্রাণ দিতে হচ্ছে খেটে খাওয়া শ্রমিকদের। তাই আন্তর্জাতিক শ্রম আইন ও দেশীয় মুজুরি কাঠামোয় বাস্তবতার নিরিখে শ্রমিকের চাহিদা, সম্মান ও মানসম্মত জীবন যাপনের দিকে খেয়াল রেখে নতুন করে তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ, পেনশন, শ্রমবীমা, পূর্নাঙ্গ বৈশাখী ও ঈদ বোনাসসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধাদি প্রদান করা সময়ের অনিবার্য বাস্তবতা।
অর্থনীতিতে উৎপাদন কাজে পরিশ্রমের বিনিময়ে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যকে ব্যবহারের নাম শ্রম। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই একশ্রেণির মানুষ অন্যের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এরাই শ্রমিক। যাদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্র নেই। পরের জমিতে বা কর্মক্ষেত্রে কাজ করে সংসার তথা ভরণ-পোষণ চালাতে হয়। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে বেশিরভাগ সময়ই মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ছিলো ‘বন্ধুর’ তথা জটিল ও কুটিল। বিভিন্ন সমস্যাবর্তে বিদ্যমান এ সম্পর্ক। এ সমস্যা মানবসমাজের একটি সুপ্রাচীন সমস্যা। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করলেও সবার সামাজিক অবস্থান একই রকম নয়। কেউ ধনী, কেউ গরিব, কেউ উঁচু বংশের, কেউ নীচু বংশের, কেউ দক্ষ, কেউ অদক্ষ। মানুষ্য সমাজের বিশেষ করে গরিব, অশিক্ষিত, শ্রমিক, কুলি-মজুরের মর্যাদা কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন কোন বিষয় দিয়ে নিরূপিত হবে, আর তার দৃষ্টিভঙ্গিই বা কীরূপ হবে, এই মৌলিক বিষয়ে পার্থক্য থাকার কারণে শ্রমিকের অধিকার, মালিকের সাথে শ্রমিকের সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের মাপকাঠীতে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অধিকার প্রতিষ্ঠা দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের সু-সম্পর্ক ও সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। পারস্পরিক সমঝোতা ছাড়া কোনোক্রমেই তা সম্ভব নয়। এ জন্য মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক রক্ষা করার ব্যাপারে আল-কুরআন তথা ইসলাম জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্র, সমাজ ও জাতির সার্বিক উন্নতি-অগ্রগতির জন্য শ্রম এক অপরিহার্য উপাদান। অর্থনীতিতে উৎপাদন কাজে পরিশ্রমের বিনিময়ে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যকে ব্যবহারের নাম শ্রম। শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তি শ্রমিক। ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম দুই ধরনের-হালাল শ্রম ও হারাম শ্রম। ইসলামে শুধু হালাল শ্রমকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। উন্নয়নের জন্য শ্রমের বিকল্প নেই। তাই শুধু মসজিদে বন্দেগিতে মশগুল না থেকে সালাত শেষে জীবিকার্জনের জন্য পৃথিবীতে বের হয়ে পড়ার কথা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘অতঃপর যখন সালাত (আদায়) শেষ হয়ে যায়, তখান তোমরা জীবিকা অন্বেষণের জন্য জমিনে ছড়িয়ে পড়।’ (আল কুরআন; ৬২ : ১০)।
পৃথিবীতে যা কিছু গড়ে উঠেছে তা সবই শ্রমের ফল। দুনিয়ার সকল নবি, সকল রাসুল ও আল্লাহভীরু সকল মানুষ নিজ শ্রমের আহার ভক্ষণ করেছেন।
হজরত আদম (আ:) ছিলেন দুনিয়ার প্রথম চাষী, হজরত নূহ (আ:) ছিলেন রাখাল, রাসূল সা: মজুরের বিনিময়ে মক্কার লোকদের ছাগল চরিয়েছেন। পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহকারীকে হাদিসের মধ্যে রাসূল সা: আল্লাহর বন্ধু বলেছেন (বুখারি)। রাসূল সা: শ্রমের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘কারো জন্য নিজ হাতের উপার্জনের চেয়ে উত্তম আহার্য আর নেই।’ আল্লাহর নবী দাউদ (আ:) নিজ হাতের কামাই খেতেন (মিশকাত-২৭৫৯)।
পৃথিবীতে মনুষ্য জীবরে আবির্ভাবের সময় থেকেই ইসলাম শ্রম ও শ্রমিকের যথার্থ মূল্যায়ন করেছে। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সময় শ্রমজীবীকে পশুর মতো হাটবাজারে বিক্রি করা হতো। রাসূল সা: সেই সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। রাসূল সা: সব সময় গরিবের সাথে থাকতেই পছন্দ করতেন। তিনি মনিব-গোলাম প্রথাকে ঘৃণা করতেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার সব আদম সন্তানকেই সম্মানিত করেছি আর কাউকে অন্যের ওপর বেশি মর্যাদা দিয়েছি’ (আল কুরআন; ১৭:৭০)।
ইসলাম সব বৈধ পেশাকে উৎসাহিত করে এবং সব পেশার মানুষকে সমান সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে থাকে। সম্পদ, বংশ ও পেশার কারণে মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয় না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নিরূপিত হয় নৈতিকতা, নিষ্ঠা ও তাকওয়ার ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সেই সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি যিনি তাকওয়াবান তথা মুত্তাকী।’ (আল কুরআন; ৪৯:১৩)।
শ্রমিকের অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করতে ইসলাম মূলনীতি ও বিধান প্রবর্তন করেছে। হযরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘সর্বোত্তম উপার্জন হচ্ছে মজুরের (কায়িক শ্রমের) উপার্জন, যদি সে মনিবের সদিচ্ছা ও ঐকান্তিকতার সাথে সম্পন্ন করে’ (মুসনাদে আহমদ)।
এ কথা সত্য যে, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মালিকের সম্পত্তিতে অধিকার নেই শ্রমিকের। এ ব্যবস্থায় ধনীরা আরো ধনী, গরিব আরো গরিব হয়। শ্রমিকের সাথে মালিক ততটুকুই সম্পর্ক রাখে যতটুকু তার স্বার্থের জন্য দরকার। অন্য দিকে সমাজতান্ত্রিক সমাজে সম্পত্তির মালিক রাষ্ট্র। কিন্তু সেই সম্পত্তির সুষম ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টন না হওয়ায় ক্রমেই বন্ধ হয় ব্যক্তি উদ্যোগ। আর বণ্টন ব্যবস্থায় অদক্ষতার কুফল ভোগ করে মূলত শ্রমিক ও গরিব শ্রেণী।
মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হবে বাবা-সন্তানের মতো। নিজের পরম আত্মীয়ের মতো শ্রমিকের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করা, পরিবারের সদস্যের মতোই তাদের আপ্যায়ন করা, শ্রমিকের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি মালিকের খেয়াল রাখা এবং তাদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি লক্ষ রাখা মালিকের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। শ্রমিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সামান্য মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিতকারীদের ব্যাপারে রাসূল সা: বলেন, ‘তাদের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন অভিযোগ করা হবে।
শ্রমিকের কাজে ফাঁকি দেয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ জন্য তাকেও কিয়ামতের দিন জবাবদিহি করতে হবে। আর শ্রমিক যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে তার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কারের ঘোষণায় রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ওই শ্রমিক যে নিজের মালিকের হক আদায় করে সে আল্লাহর হকও আদায় করে’ (মিশকাত শরিফ : হা/১১)। হযরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, যেই সত্তার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার কসম! যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, হজ ও আমার মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহারের ব্যাপারগুলো না থাকত, তাহলে আমি শ্রমিক হিসেবেই মৃত্যুবরণ করতে পছন্দ করতাম’ (বুখারি শরিফ : হা/২৫৮৪)।
লেখক : বিলাল মাহীনি, প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর, যশোর।
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।