বাংলাদেশের ঈদ উৎসব: একাল-সেকাল

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল
মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত জাঁকজমক ও ধুমধামের সঙ্গে এই ধর্মীয় দিবস দু’টি পালিত হতে দেখা যায়। ঈদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রথম ঈদ পালিত হয় দ্বিতীয় হিজরীর ১ শাওয়াল মোতাবেক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ মদিনায়। আর মক্কায় প্রথম ঈদ পালিত হয় অষ্টম হিজরী মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর প্রায় ১১ দিন পর। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ। বাংলাদেশে প্রথম কোথায় ঈদ পালিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ধারণা করা যায়, চট্টগ্রামের সন্দীপ অঞ্চলে প্রথম ঈদের জামায়াত হয়েছিল। ঢাকায় সম্ভবত প্রথম ঈদ উদযাপিত হয় সুলতানি আমলে (১৩০০-১৫৩৮ খ্রি.) মোটামুটি দুইশত বছরের বেশি সময়ে নগরকেন্দ্রিক ঈদ উৎসবের কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে এখন যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে, একশ’ বছর আগেও কি এভাবে হতো? সাধারণ মানুষ কি আজকের মতো অধীর আগ্রহ, উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন ঈদের চাঁদের দিকে? ঈদের ধুমধামের দিকে? ইতিহাস বলে ‘না’। তবে সে আমলে কীভাবে বাংলাদেশে ঈদ উৎসব পালিত হতো।
ইসলাম প্রচারের শুরুতে অর্থাৎ আদি বাঙালি মুসলমানরা কীভাবে ঈদ উৎসব পালন করতো, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। তবে বলা যেতে পারে আদিতে প্রচার করা আরবের উদযাপিত ঈদের আদি রূপই হয়তো তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু কালের গর্ভে সময়ের বিবর্তনে সে রূপ চিরতরে হারিয়ে গেছে। কখনো ধর্ম নেতারা মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন তাদের নিজের গড়া নতুন অনুষ্ঠান। কখনো শাসকশ্রেণির নির্দেশে যুক্ত হয়েছে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকর্ম। কখনো-বা লৌকিক ধর্মের প্রভাব এসেছে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে। সেজন্য আবারও বলতে হয় বাংলাদেশে যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে, তাতে সেখানে প্রভাব ফেলেছে কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ্বাস। উৎসব হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ শতবর্ষ আগে ঈদের দিনটি কীভাবে পালন করতেন, সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। আর্থসামাজিক পটভূমিতে মানুষের মনেরও পরিবর্তন ঘটেছে। ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের ফলে। এখানে পুরনো আমল বলতে আমরা আশি-নব্বই বছরের বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরতে চাই। শতবর্ষ আগে সাহিত্য, সংবাদ সাময়িকী পত্রে ঈদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বিবরণ আমরা পাইনি। এদেশের হিন্দু, মুসলমান যিনিই আত্মজীবনী লিখে গেছেন, তাদের রচনায় আমরা দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, মহররম, এমনকি রথযাত্রা, দোল পূর্ণিমা, দিপালী উৎসব এরূপ বিভিন্ন পূজা-পার্বণ সম্পর্কে বিস্তর উল্লেখ দেখতে পাই। শুধু পাওয়া যায় না ঈদুল ফিতর সম্পর্কে। তবে একালে যারা জন্মেছেন, তাদের বিবরণীতে কচিৎ ঈদুল ফিতর সম্পর্কে খানিকটা তথ্য পাওয়া যায়। এতে প্রমাণিত হয় ঈদুল ফিতরের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ উৎসব শতবর্ষ আগেও বাঙালির ঘরে ঘরে আজিকার মতো অনাবিল হাসি, আনন্দের বার্তা বয়ে আনতে পারেনি। এ থেকে যদি আমরা বলি ঈদুল ফিতর সেকালে বাংলাদেশে তেমন কোনো বড় উৎসব হিসেবে পালন হয়নি, তবে কি তা ভুল বলা হবে? মনে হয় নিশ্চয়ই না। আজ আমরা যে ঈদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি, বাঙালির ঈদকে দেখি একটা সামাজিক ধর্মীয় বড় উৎসব হিসেবে তা কিন্তু সত্তর-আশি বছরের ঐতিহ্য মাত্র। বর্তমানে গ্রাম বাংলায় রোজা ও ঈদ যেভাবে পালিত হচ্ছে, তা কিন্তু সে আমলে নব্বই বছর আগেও অবশ্যই মোটেই এভাবে পালিত হতো না। ব্রিটিশ আমলে যে উৎসব সবচেয়ে ধুমধামের সঙ্গে এ বাংলায় প্রচলিত ছিল এবং ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি ছুটি বরাদ্দ ছিল, তা হলো খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের “ক্রিসমাস ডে”। ব্রিটিশ আমলে বিদ্যার দিক থেকে মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে হিন্দুদের থেকে ছিল অনেক পিছিয়ে। ফলে “ক্রিসমাসের” পরেই সরকারিভাবে তো বটেই, সম্প্রদায়গত আধিপত্য এবং ঐতিহ্যের কারণে এই অঞ্চলে হিন্দুদের “দুর্গাপূজা” হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়, জাঁকালো এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। অফিস-আদালতে ইংরেজ আমলে সরকারি ছুটির পরিমাণ ঈদের থেকেও পূজার জন্য ছিল অনেক বেশি। সে আমলে সরকারি নথিপত্রেও পূজা সম্পর্কে আছে পর্যাপ্ত তথ্যাদি।
শাসক ইংরেজরা স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের ঈদকে গুরুত্ব দেয়নি। এজন্য সরকারি ছুটিও বরাদ্দ ছিল কম। তাছাড়া মুসলমানদের পক্ষে ঈদকে সে আমলে উৎসবে পরিণত করা সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে। কারণ গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মুসলমান ছিল বিত্তহীন ও নিরক্ষর। বরং মুসলমানের মহররমের, বিশেষ করে তাজিয়ার বর্ণনা পাওয়া যায় বিস্তর জায়গায় ও সংবাদপত্রে। এটি সে সময় ঢাকায় বেশ জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে পালিত হতো। ঢাকার হোসেনি দালান ছিল শিয়া সম্প্রদায়ের মহররমের পুণ্যভূমি। মুসলমানদের উৎসবের শ্রেষ্ঠ প্রাণ কেন্দ্র নবাবী আমল থেকেই পৃষ্ঠপোষকতা ছিল এর পিছনে। ঈদ মুসলমানদের প্রধান উৎসব হিসেবে পালিত না হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ ছিল বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা। দীর্ঘদিন ইংরেজ শাসনের প্রভাবে মুসলমানরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে ফরায়েজী আন্দোলনের আগে (১৮১৮ খ্রি.) গ্রামাঞ্চলে মুসলমানদের কোনো ধারণা ছিল না বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে। ইসলাম ধর্মে লোকজ উপাদানের আধিপত্য ছিল প্রায় ক্ষেত্রেই হিন্দু রীতিনীতির ওপর। ১৮৮৫ সালে জেমস ওয়াইজ তার “ঘড়ঃবং ড়হ ঃযব জধপবং পধংঃড়ং ধহফ ঃৎধফবং ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ খড়হফড়হ” বইতে লিখেছেন, “বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সরল অজ্ঞ কৃষক। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ঈদের দিনে গ্রামবাসীরা জমায়েত হয়েছেন ঈদের নামাজ পড়বেন বলে, কিন্তু সে সময়ে দুর্ভাগ্য এই যে, জামাতের একজনও জানতেন না কীভাবে ঈদের নামাজ পড়তে হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় নৌকাযোগে এক যুবক যাচ্ছিলেন তাকেই ধরে নিয়ে এসে পড়ানো হয়েছিল ঈদের নামাজ”। ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন উল্লেখ করেছেন তাঁর পিতার সহকর্মী যিনি ছিলেন সে আমলে একজন নামজাদা পীর, তাঁকে বলেছিলেন “মুসলমান ছিলাম বটে [তার জন্ম ১৮৯৮ সালে] কিন্তু ছেলেবেলায় রোজা বা ঈদ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। মসজিদ ছিল হয়তো কয়েক গ্রাম মিলে একটি। সে সময় বাংলা “মাসিক সঞ্জীবনী” পত্রিকার সম্পাদক (কৃষ্ণ কুমার মিত্র) লিখেছিলেন [উনিশ শতকের মাঝামাঝি ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলের মুসলমানদের সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন] “সে সময় মুসলমানরা নামাজ পড়িত না। গ্রামে কোন মসজিদ ছিল না। স্থানে স্থানে দরগা ছিল। মুসলমানরা তহবন্দ বা লুঙ্গি পড়িত না। কাছা কোঁচা দিয়া ধুতি পরিধান করিত। তাহাদের অনেকের নাম ছিল যেমন, গোপাল, ঈশান, ধীরেন ইত্যাদি। মুসলমানরা সেই সময় দুর্গা, কালী, মনসা প্রভৃতি পূজার ভোগের জন্য কুমড়া, কলা, মানকচু ও বলির জন্য পাঠা দিতো। তাহাদের দর্গায় গরু প্রভৃতি জন্তুর মূর্তি রাখা হইতো। মাদার বাঁশের খেলা হইতো (অধুনালুপ্ত পাক-ভারতের বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক সুফি সাধক হজরত বদীউদ্দীন শাহ-ই-মাদার)। বাঁশের ওপর লম্বা চুল বাধিয়া হিন্দু-মুসলমান সবাই দল বাঁধিয়া বাড়িতে বাড়িতে চাল সংগ্রহ করিত। দর্গাতে শিরনী দিতো। মানত করিতো। মুসলমানরাই বলির জন্য হাঁস দিতো। মুসলমানরা সেকালে কালীপূজার জন্য পাঁঠা বলি দিতো। দুর্গাপূজার জন্য ডিম দিতো।
আবুল মনসুর আহমদ তাঁর আত্মজীবনীতে আরো লিখেছেন, “উনিশ শতকের শেষার্ধেও সে সময় নামাজ রোজা চালু ছিল না। তাদের গ্রামাঞ্চলে ছিল না কোনো মসজিদ। তরুণদের তো কথাই নেই। বয়স্করাও সকলে রোজা রাখতেন না। দিনের বেলা তারা তামাক ও পানি খেতো। শুধু ভাত খাওয়া থেকে বিরত থাকতো। পানি ও তামাক খাওয়াতে রোজা নষ্ট হতো না। এই বিশ্বাস ছিল তখন তাদের মনে। রোজার মাসে মাঠে যাওয়ার সময় একটা বাঁশের চোঙ্গা রোজাদাররা সঙ্গে রাখতেন। পানি বা তামাক খাওয়ার শখ হলে এই চোঙ্গার খোলা মুখে মুখ লাগিয়ে খুব জোরে দম ছাড়া হতো। মুখ তোলার সঙ্গে সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি গামছা, নেকড়া বা পাটের টিপলা দিয়ে চোঙ্গার মুখ কষে বন্ধ করা হতো, যাতে বাতাস বের হয়ে আসতে না পারে। তারপর আবশ্যক মতো পানি ও তামাক পান করে চোঙ্গাটা আবার মুখের কাছে ধরা হতো। খুব ক্ষিপ্র হাতে চোঙ্গার টিপলাটা খুলে মুখ লাগিয়ে চুষে চোঙ্গায় বন্ধ রোজা মুখে আনা হতো এবং ঢোকা গিলে একেবারে পেটের মধ্যে ফেলে দেয়া হতো। খুব ধার্মিক ভালো মানুষ দু-একজন এমন করাটা পছন্দ করতেন না বটে, কিন্তু সাধারণভাবে সে সময় এটাই চালু ছিল।”
“তাবাকাৎ-ই-নাসিরি”র লেখক ঐতিহাসিক মিনহাজ উস-সিরাজ সেকালের ঈদ উৎসব সম্পর্কে জানিয়েছেন, “বাদশাহ ধর্মীয় আলোচনায় ব্যস্ত থাকতেন, ঈদের নামাজ পড়ানোর জন্য নিয়োগ করতেন ধর্মীয় ইমাম। শহরের বাইরে উন্মুক্ত জায়গায় অথবা গ্রামে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হতো এবং এসব স্থানকেই ঈদগাহ নামে অভিহিত করা হতো।”
আগেই বলা হয়েছে ঈদ সম্পর্কে আমরা সেকালে যে বিবরণ পাই, তা থেকে ধরে নেয়া যায় রমজান মাস থেকেই শুরু হতো ঈদের প্রস্তুতি। এ উৎসব শুরু হতো রমজানের চাঁদ দেখা থেকে। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না।
আবুল মনসুর আহমদ সেকালে ঈদের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে আরও বলেছেন, “এই অঞ্চলে কোনো মসজিদ বা জুমার ঘর ছিল না। বছরে দুইবার ঈদের জামায়াত হইতো বটে, কিন্তু তাতে বড়রাই শামিল হইতো। তাই জামায়াতে খুব অল্প লোকই দেখা যাইতো। সাধ্যমতো নতুন কাপড় চোপড় পরিয়া লোকেরা বেদম গান বাজনা করিতো। সারারাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইতো। প্রায়ই বাড়ি বাড়ি ঢোল ডাগর দেখা যাইতো। ঈদের জামায়াতেও লোকেরা কাছা, ধুতি পরিয়াই যাইতো। নামাজের সময় কাছা খুলিতেই হইতো। সে কাজটাও তাহারা নামাজে দাঁড়াইবার আগেতক করিত না। প্রথম প্রথম নামাজের কাতারে বসিবার পর অন্যের অগোচরে চুপি চুপি কাছা খুলিয়া নামাজ শেষ করিয়া কাতার হইতে উঠিবার আগেই আবার কাছা দিয়া ফেলিত”।
অজ্ঞতা ও কুসংস্কার তখন বাঙালি মুসলমান সমাজকে নিদারুণভাবে গ্রাস করে। তারা সহজ-সরল ইসলাম ভুলে গিয়ে রমজানে ও ঈদ উৎসবের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বহু কুপ্রথা, অন্ধবিশ্বাস, ইসলামবিরোধী আচার অনুষ্ঠানে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সে সময় সত্যিকারের ইসলাম হারিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে কুসংস্কার ও অনৈসলামিক কার্যকলাপে লিপ্ত থেকে অন্ধকারের অতল তলে হারিয়ে যায়। তখনকার মুসলমানদের সমাজে এই অধঃপতন দেখে সে সময়ে ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০ খ্রি.) স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। জেমস ওয়াইজ আরও লিখেছেন, ‘দীর্ঘকাল হিন্দুদের সংস্পর্শে থাকার ফলে ঈদ উৎসবের ধর্মীয় ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুদের মতো যেসব কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস প্রবেশ করে তার বিরুদ্ধে হাজী শরীয়তুল্লাহ সর্বপ্রথম আন্দোলন আরম্ভ করেন। তিনি ইসলাম ধর্মের বহু দেব-দেবী, ভ্রান্ত অলীক বিশ্বাসও পাপপূর্ণ নতুন প্রথাগুলোর উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন করেন। এভাবে হাজী শরীয়তুল্লাহ দীর্ঘকাল যাবৎ পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজ থেকে বহু অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার দূর করেন।’
এবারে ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। সেকালে ঢাকায় রমজানের চাঁদ দেখার জন্য বিকেল থেকেই বড় কাটরা, আহসান মঞ্জিল, হোসেনি দালানের ছাদে ভিড় জমে উঠতো। চাঁদ দেখামাত্রই পরস্পর সালাম বিনিময় এবং সেই সঙ্গে গোলাবাজি ও তোপের আওয়াজে সারা ঢাকা শহর প্রকম্পিত ও মুখরিত হয়ে উঠতো। ঢাকার রমজান ও ঈদের বড় আকর্ষণ ছিল রকমারি খাবার। রোজার ঘরে পর্যাপ্ত ইফতারি থাকা সত্ত্বেও সবাই একবার ‘চকে’ ছুটে যেতেন। চকবাজার সেই মোগল আমল থেকেই তার ঈদের আভিজাত্য বজায় রেখেছে। চকবাজার সেই আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য, খাবার-দাবার ও আড্ডার মুখ্য কেন্দ্রস্থল ছিল। ‘চকে’ সে আমলের রকমারি ইফতারি খাবারের মধ্যে বিখ্যাত ছিল শিরমাল, বাখরখানি রুটি, চাপাতি, নানরুটি, কাকচা, নান খাদাই, শিক কাবাব, হা-ি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোপ্তা, সামী কাবাব, টিকিয়া কাবাব, পরোটা, বোগদাদী রুটি, শরবতী রুটি ও মোরগ কাবাব, ফালুদার শরবত, জাফরান শরবত, বেলের শরবত ও নানা রকম ফল। ‘চক’ এখনও রোজার সময় প্রায় সেই পুরনো ঐতিহ্যকে বজায় রেখেছে।
ঢাকার তোরাবন্দি খাবারও ছিল ঈদ উৎসবে বিখ্যাত। বিশেষ উৎসবে এর কদর ছিল অভাবনীয়। এই খাবারে থাকতো চার প্রকারের রুটি, চার রকমের পোলাও, চার রকমের নান রুটি, চার প্রকারের কাবাব, পনীর, বিরিয়ানি, চাটনি অর্থাৎ প্রত্যেক পদের খাবার চার প্রকারের মোট চব্বিশ পদের নিচে খাবার থাকতো না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে আশি-নব্বই বছর আগেও ঈদুল ফিতর বাংলাদেশে কোনো ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়নি এ কথা নিঃশংসয়ে বলা যেতে পারে।
মোগল আমলে ঈদের দিন যে হইচই ও বর্ণাঢ্য আনন্দ উৎসব পালিত হতো তা’ বহিরাগত উচ্চপদধারী বা ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। এ সবের সঙ্গে সাধারণ গ্রামবাংলার মানুষের ছিল যোজনব্যাপী ব্যবধান। আর সে আমলে ধনাঢ্য মুসলমান ব্যক্তিরা পথে প্রচুর পরিমাণ টাকা কড়ি ছড়িয়ে দিতেন, গরিবদের কাছে কিছু দান-খয়রাতও করতেন, এমন তথ্য সে আমলে বিদ্যমান রয়েছে। মোগলরা যে ঈদকে গুরুত্ব দিতেন, তা বোঝা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শাহী ঈদগাহের ধ্বংসাবশেষ দেখে। এ রকম একটি ঈদগাহ এখনো বিদ্যমান রয়েছে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায়। শাহ সুজা যখন বাংলার সুবাদার তখন তাঁর প্রধান আমাত্য মীর আবুল কাসেম ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন এই ঈদগাহটি। সুবাদার, নাজিম ও অন্যান্য মোগল কর্মকর্তারা নামাজ পড়তেন এখানে। তবে এ কথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে মোগল আমলে ঈদের দিন ঈদগাহে যেতেন শুধু মোগলরাই। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্থান সেখানে কখনোই ছিল না। মুষ্টিমেয় মোগল আমাত্য ও কয়েকজন ধনী মানুষ পড়তো সেখানে ঈদের নামাজ।
এ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ দশকের গ্রামাঞ্চলে ঈদ পালনের কয়েকটি বর্ণনা পাই খন্দকার আবু তালিবের নিবন্ধ থেকে “রোজার পনেরো দিন যাওয়ার পর হতেই গৃহবধূরা নানা রকম নকশি পিঠা তৈরি করতে আরম্ভ করতো। এদের মধ্যে ফুল পিঠা, পাঁপড় পিঠা, ঝুরি, হাতে টেপা সেমাই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শবেকদরের রাতে মেয়েরা মেহেদী এনে তা বেঁটে হাতে নানা রকম চিত্র আঁকতো। ফুল পিঠা তৈরি করার সময় বউয়েরা ‘প্রিয় স্বামী’, আর অবিবাহিত মেয়েরা ‘বিবাহ’ ও ‘প্রজাপতি’ এঁকে রাখতো। ঈদের দিনে যুবক-যুবতী, বন্ধু-বান্ধবীদের পাতে দেয়ার জন্যই এ ধরনের ফুল পিঠা তৈরি করা হতো”।
সেকালের বাংলার রোজা ও ঈদ একালে এখন অবশ্যই ভিন্নতর রূপ পেয়েছে। বছর ঘুরে আসে, গ্রামে রোজা, রমজান মাস, গ্রামবাংলার মানুষের কাছে পরম বিশ্বাস চাঁদ দেখে রোজা শুরু, চাঁদ ওঠা দেখে রোজার শেষ। চাঁদই তাদের লক্ষ্যস্থল। রমজানের ঈদে চাঁদ দেখার জন্য একালে পাড়ায় পাড়ায় ধুম পড়ে যায়। পবিত্র ঈদের চাঁদ দেখে তারা সালাম করে। সালাম করে বাড়ির গুরুজনদের। কখনোবা বাজি ফোটায়। বন্দুক মেরে দশ গ্রামের লোককে জানিয়ে দেয়। রাতে আতশবাজি ও আলোকমালায় সজ্জিত করে আবাসগৃহ, সাইরেন বাজায়। ছেলেমেয়েদের মধ্যে ধুম পড়ে যায় রোজা রাখার জন্য। বিশেষত ভোররাতে সাহরী খাওয়ার সময় তাদের ঘুম থেকে না ডাকলে ভীষণ কুরুক্ষেত্র বেধে যায় পরদিন। রোজা থাকতে দাও আর না দাও অন্তত শেষ রাতে উঠে সবার সঙ্গে ছোট ছেলেমেয়েরা সাহরী খায়। এতে অনাবিল আনন্দ-ফুর্তি ও প্রতিযোগিতা চলে কে বেশি রোজা রাখতে পারে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার আগেও আমরা গ্রামবাংলার এরূপ স্বচক্ষে রমজান মাসে দেখেছি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ আগেও যেমন বঞ্চিত ছিলেন ঈদের আনন্দ থেকে, এখনো বঞ্চিত আছেন। তদ্রƒপ, প্রতিনিয়ত মোগল আমলের ইতিহাসে আমরা দেখেছি, বিত্তবানরা ঈদের দিন ছুড়ে দিচ্ছেন রেজগী পয়সা আর সাধারণ নিরন্ন, বঞ্চিত মানুষ তা কুড়িয়ে নিচ্ছেন কাড়াকাড়ি করে। এখনো তার এ আমলে কোনো হেরফের হয়নি, বরং বঞ্চনা আরো বেড়েছে। আমরা চোখের সামনে দেখেছি বাংলাদেশে ধনীর গৃহে জাকাতের কাপড় নেয়ার জন্য ছিন্নমূল মানুষের লুটোপুটি লাইন, তা আমাদের হতভাগ্য, বঞ্চিত, দরিদ্র নিপীড়িত মানুষের চেহারাই তুলে ধরে। সুতরাং ঈদুল ফিতরের আনন্দ সাধারণ মানুষের মনে আজ আর কোনোই রেখাপাত করে না। ঈদুল ফিতরের জামায়াতের আগে থেকেই বিত্তবানদের ফিতরার অর্থ ও সাহায্য নেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় শত শত ছিন্নমূল মানুষকে। উৎসব সর্বাঙ্গীণ আনন্দময়, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে তখনই, যখন আসে বিত্ত বন্টনের সামঞ্জস্য। তা না হলে ধর্মীয় উৎসব (ঈদুল ফিতর) মূল আবেদন হ্রাস পায়।
ফরায়েজী আন্দোলন এবং পরবর্তী ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনসমূহ পাল্টে দিতে পেরেছিল বাংলাদেশের এই মুসলমানদের মনমানসিকতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও লৌকিক, স্থানীয় উপাদানসমূহ বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়েছে ঈদের সঙ্গে। অনেকগুলো এসেছে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন উৎসব ও লোকাচার থেকে।
এই শতকের শুরু থেকেই যখন রাজনৈতিকভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে ঈদ। বাংলাদেশের দুটি ঈদ (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা) জাতীয় উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। এদেশে স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে ঈদ এবং এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে আগের অজ্ঞতাও তেমন নেই এখনকার মুসলমানদের মধ্যে। ফলে স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমপ্রধান দেশে ঈদ এখন নিজের গৌরবোজ্জ্বল, ঐতিহ্যম-িত স্থান করে নিয়েছে এবং আমাদের বাংলাদেশেও তা বিরাট গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় তামুদ্দনিক জাগ্রত করেছে এই ঈদুল ফিতর, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সবাইকে ঈদ মোবারক। কবির ভাষায় বলতে গেলে-
“এসো মুসলিম তসলিম নাও,/নাও এ তোহফা বেহেশতের/তশতরী ভরে শীরনি বিলাও/নির্মল ইনসানিয়াতের।”
তথ্য সূত্র : (১) বাংলাদেশে ঈদ ঃ সেকাল-একাল : মুনতাসীর মামুন, (২) রোজা এবং ঈদের উৎসব ঃ সেকালে ঃ আলমগীর জলীল, দৈনিক পূর্বাঞ্চল, খুলনা, ৭ জানুয়ারি ২০০০ খ্রি., (৩) আত্মচরিত ঃ কৃষ্ণ কুমার মিত্র, কলকাতা ১৯৪৭ খ্রি., (৪) আত্ম কথা ঃ আবুল মনসুর আহমদ, ঢাকা ১৩৭৮ বাংলা, (৫) ঈদ ঃ আমাদের কালের কথা ঃ খন্দকার আবু তালেব, সাপ্তাহিক ঢাকা, ঈদ সংখ্যা ১৯৮৮ খ্রি., (৬) ঢাকার ঈদ ঃ আব্দুস সাত্তার, (৭) লৌকিক সংস্কার ও মানবসমাজ : আব্দুল হাফিজ, ঢাকা, ১৯৯৪ খ্রি.।
লেখক: কলামিস্ট, সাহিত্যিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

Please follow and like us:

Check Also

২৮শে এপ্রিল খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবারেও ক্লাসের পরিকল্পনা

আগামী ২৮শে এপ্রিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সব রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।