আবু সাইদ বিশ্বাস : দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর রোযাদারের জন্য পবিত্র ঈদুল ফিতর এক মহা আনন্দের দিন। তাই তো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রেখে যাওয়া কবিতা আজো আকাশে বাতাসে সুরের ঝংকার তোলে “ও মন রমযানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানী তাকিদ”। আজ শুক্রবার পবিত্র ঈদুল ফিতর । সারাদেশে দিনটি যথাযথ ভাবে পালিত হচ্ছে।
এবার করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে ঈদগাহে নামায আদায় না করে মসজিদে নামায আদায়ের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পশ্চিম আকাশে পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজাদার অরোজাদার সকলের মাঝে বইতে শুরু করবে আনন্দের বন্যা। শুধু রাতটা পোহালেই শুরু হবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে মুসলমানদের মিলনের বন্ধন। রাজপ্রাসাদ থেকে কুড়েঘর পর্যন্ত খুশীর আলোয় আলোকিত হবে। একে অন্যের সাথে কুশলাদি বিনিময় করতে থাকবে। কোলাকুলি আর ফিরনী সেমাই খাওয়ার ধুম থেকে বাদ যাবে না কেউই। ঘুম থেকে ওঠার পরই শুরু হয়ে যাবে এসব ধুমধাম। পুরো বাংলাদেশ আনন্দের আলোয় ঝলমল করতে থাকবে। ইতোমধ্যে সকলেই ঈদের সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। প্রত্যেকেই জামাকাপড়সহ পছন্দের জিনিস পত্র ক্রয় করেছেন। বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের মাঝে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী বিতরণ করছেন। পাশাপাশি ঈদ কার্ডে মনের কথা লিখে প্রিয়জনকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন অনেকেই। অপরদিকে ঈদ যতই কাছে আসছে মোবাইল ফোন খরচ ততই বাড়ছে। আর মোবাইল কোম্পানীগুলোও ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার কথা ঘোষণা করছে। এসব সুযোগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে প্রিয়জনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মোবাইল থেকে কলের পাশাপাশি এস এম এস ও বিভিন্ন লগো পাঠিয়ে প্রিয়জনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে অনেকেই। এসবের পাশাপাশি ই মেইলের মাধ্যমেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছে অনেকে। আবার ফেসবুক ও টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ঈদের শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে। পব্ত্রি ঈদ মুসলমানদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করে এবং সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে। বিশ্ব মুসলিম একই আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় পবিত্র ঈদ। ধনী গরিব ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়ে রাজা প্রজা এক কাতারে শামিল করিয়ে দেয় পবিত্র ঈদ। হিংসা বিদ্বেষ ও অহংকারসহ সকল অন্যায় ও পাপাচার মুছে দিয়ে নতুন করে সুখী পবিত্র জীবন যাপন শুরু করার তাগিদ এনে দেয় পবিত্র ঈদ।
দ্বিতীয় হিজরীতে ঈদের নামায ওয়াজিব হয়। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, ঈদের নামায পড়ার বিধান নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূল (স.) মৃত্যু পর্যন্ত কোন বছরই কোন ঈদের নামায পড়া বাদ দেননি। তেমনি খুলাফায়ে রাশিদীনের কেউ তা বাদ দেননি। এর দ্বারা ঈদের নামায ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করলে গুনাহাগার হবে।
রমযান শেষে ১ শাওয়াল ঈদুল ফিতরের নামায পড়া ওয়াজিব। তবে যুক্তিসঙ্গত ওজর থাকলে পরের দিন পড়া যাবে। অবশ্য ঈদুল আযহার নামায ওজর থাকলে পরবর্তী দুদিন পর্যন্ত পড়া জায়েয।
সূর্য আনুমানিক তিন গজ পরিমাণ উপরে উঠার পর অর্থাৎ সূর্যোদয়ের ২৩/২৪ মিনিট পর থেকে দ্বি-প্রহরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত। সূর্য তিন গজ পরিমাণ উপরে উঠা পর্যন্ত সময়টুকুকে তার উদয়কাল বলে গণ্য করা হয়। এ সময়ে কোন নামায পড়া জায়েয নেই। ঈদুল আযহার নামায অপেক্ষাকৃত আগে এবং ঈদুল ফিতরের নামায কিছু বিলম্বে আদায় করা উত্তম। যেহেতু ঈদুল আযহার নামাযের শেষে কুরবানী দিতে হয়। সেজন্য ঈদুল আযহার নামায যথাশীঘ্রই আদায় করা উত্তম।
ঈদের দিন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই আনন্দে মেতে ওঠে। একেকজন একেকভাবে আনন্দ উপভোগ করে থাকে। বিশেষ করে ছোট ও তরুণ তরুণীদের আনন্দ উপভোগটা সবারই নজরে পড়ে। তারা ঈদের দিন ভোরে ফিরনী সেমাই খেয়ে বন্ধু বান্ধবদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে ছুটে যায় ঈদের নামাযে। নামায শেষে ছোটরা খেলার সামগ্রী নিয়ে বন্ধু বান্ধবদের সাথে খেলায় মেতে ওঠে। আর অপরদিকে তরুণ তরুণীরা ছুটে যায় সিনেমা হলে বা টেলিভিশনের সামনে। অনেকে ভিসিডিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দর্শনের মাধ্যমে ঈদের আনন্দ উপভোগ করে থাকে।
চাঁদ দেখে রোযা শুরু ও সমাপ্তির নির্দেশনা ইসলাম দিয়েছে। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে। হয়রত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, রমযানের চাঁদ দেখা না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা রোযা রেখো না। আর শাওয়ালের চাঁদ না দেখা পর্যন্ত তোমরা ইফতার করো না। আকাশ মেঘলা থাকার দরুন চাঁদ তোমাদের দৃষ্টিগোচর না হলে রমযানের দিনগুলো পূর্ণ করে নেবে। (বোখারী ও মুসলিম)। চাঁদ দেখার ব্যাপারে ইমামদের বক্তব্য হচ্ছে, শাওয়ালের চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়ার জন্য কমপক্ষে দু‘জন বিশ্বস্ত লোকের স্বাক্ষ্য অপরিহার্য। আর মেঘ মুক্ত বা পরিষ্কার আকাশ থাকলে অনেক লোকের চাঁদ দেখা শর্ত। উল্লেখ্য, মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হয়ে গেলে চাঁদ দেখার প্রয়োজন নেই।
ঈদ শব্দের সরল অর্থ আনন্দ। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈদ হচ্ছে বান্দার জন্য বিরাট আতিথেয়তা। তাই তিনি ঈদের দিন রোযা পালনকে হারাম করে দিয়েছেন। ফিতর মানে রোযা ভাঙ্গা। ইফতার শব্দও ফিতর থেকে এসেছে। ঈদুল ফিতর মানে রোযা ভাঙ্গার ঈদ। অন্য এক মত অনুযায়ী ফিতর ফিতরাত শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ স্বভাব প্রকৃতি। রমযানের দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় কষ্ট ও ক্লান্তির পর স্বাভাবিক ভাবেই সুখ ভোগের বিষয়টি এসে যায়। ঈদুল ফিতর রোযাদারদের সেই স্বভাবসমেত সুখ উপহার দেয়।
ঈদের দিন সর্বপ্রথম রোজা ভাঙ্গার সাথে সাথে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় ও রাসূল (সাঃ) এর উপর দুরুদ পাঠ করা উচিত। ঈদের রাতে ইবাদাত করতেও উৎসাহিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হযরত ওবাদাহ বিন সামেত (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দু’ রাত সজাগ থাকে। যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে কিন্তু তার অন্তর মরবে না। (তাবরানী)। ঈদের দিন ভোরে ঈদের নামাজের আগে ফিতরা আদায় করতে হবে। তারপর ঈদের নামায আদায় করতে হবে। ঈদের নামায মাঠে আদায় করাই উত্তম। সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে ঈদে যাওয়াও উত্তম। ভিন্ন পথে ঈদগাহে যাতায়াত ও ভোরে উঠে খেজুর বা মিষ্টি কিছু খাওয়া রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাত। ঈদের দিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করা উত্তম। নতুন পোশাক পরিধান করায় কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এটিকে প্রাধান্য দেয়া ভ্রান্ত ও অমূলক ধারণা।
ঈদের আনন্দ সর্বব্যাপী সবার জন্য এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। তবুও ঈদুল ফিতরের আসল উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ ঈদ প্রকৃত সিয়াম পালনকারীদের জন্য। যারা রমযান মাসব্যাপী সুবহে সাদেক থেকে সূযাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে নিবৃত্ত থাকেন তারাই কেবল তাকওয়ার গুণাবলী অর্জনে সক্ষমতা লাভ করেন এবং তাদের জন্যই ঈদ নিয়ে আসে দুনিয়া ও আখেরাতের সওগাত। ঈদের আনন্দ হোক প্রতিদিনের আনন্দ। সবার ঘরে, সবার মুখের ঈদের হাসিটুকু স্থায়িত্ব পাক।
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। ক্রাইমবাতার পক্ষ থেকেও সকলকে ঈদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানো হচ্ছে।