করোনা অতিমারিতে প্রায় পৌনে পাঁচশ’ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মাঝে অসন্তোষ থাকলেও জাতির আগামিদিনের কর্ণধর হিসেবে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে অধিকতর গুরূত্ব দিয়ে সরকার শ্রেণিকক্ষে সশরীরে পাঠদান বন্ধ রেখেছে। তবে লোকমুখে প্রচলিত ‘স্কুল-কলেজ-মাদরাসা বন্ধ’ এটা মানতে নারাজ শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষকগণ। তদের দাবি, শিক্ষাবন্ধব বর্তমান সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখলেও ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবাদে এক দিনের জন্যও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। বরং অনলাইন টিচিং-লার্নিং এবং সংসদ টেলিভিশনে সকল শ্রেণির ক্লাস নিয়মিত পরিচালনার ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হচ্ছে না; বরং তারা প্রমোশন পাচ্ছে। যদিও অনলাইন শিক্ষায় তথা পঠন-পাঠনে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং নিম্ন আয়ের মানুষের অংশগ্রহন শতভাগ নিশ্চয়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। করোনাভাইরাস মহামারিকালে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এক বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশই নিতে পারেনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে করোনায় ভারতীয় ধরণ দৃশ্যমান হওয়ায় সীমান্ত অঞ্চল এবং রাজধানীসহ আশেপাশের জেলাগুলোতে সংক্রমন বাড়ছে। সরকারের করোনা বিশেষজ্ঞ টিম এখন লকডাউনের পরিবর্তে শাটডাউনের কথা ভাবছে। সংক্রমন ও মৃত্যু হ্রাস ও দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সরকারি নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে প্রশাসনকে আরও কঠোরতা দেখানো দরকার বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন মহল। করোনাকালীন এ অতিমারি থেকে শিক্ষা ব্যবস্থায় কী প্রকার পরিবর্তন আনা যায়, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। অনলাইনে হোক আর সশরীরে উপস্থিতির মাধ্যমে হোক শিক্ষা ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার আদলে ‘রূপকল্প-২০৪১’ নির্মাণ করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশে লক্ষণবিহীন করোনা রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি এবং মাস্কের ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষ উদাসীন। শতভাগ মানুষ যদি শুধু মাস্ক ব্যবহার করতো, তাহলে ৯০ শতাংশ মানুষই সুস্থ থাকতো। জনসমাগম এড়িয়ে চলা এবং একে অপরের থেকে যদি কমপক্ষে ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখা যেতো, তবে আক্রান্তের সংখ্যা কমে যেতো।
বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য অনলাইনে ফ্রি রেজিস্ট্রেশন ও টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করা প্রয়োজন। একজন চিকিৎসকের একদিনে ১০ জনের বেশি রোগী দেখা উচিত নয়। এতে চিকিৎসকরা নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হবেন এবং সাধারণ রোগীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ কমানো যাবে। গাড়িচালক ও ঘরের কাজের লোকদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। অফিস-আদালত ও গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে জরিমানা করা দরকার।
শিক্ষাখাতেই এ সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির মাত্রা ও পরিমাণ অনেক। প্রত্যক্ষভাবে, গত বছরের মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া বিক্ষিপ্ত লক-ডাউনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতির পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব। পরোক্ষভাবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দুটি খাতে বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রথমত, শিক্ষা উপকরণের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ খাতের ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে লোকসানের মুখে পড়েছেন। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পরিবহন খাতে সেবা প্রহীতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেনসহ বহু স্কুল মাদরাসা।
অনলাইনে পাঠদান নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরতে চাই। এক. অনলাইনে পাঠদানের কার্যকারিতা হিসাব করলে দেখা যায় এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকগণ সমান গুরুত্ব বহন করেন। তাই অনলাইন শিক্ষায় অভিভাবকের সম্পৃক্ততা জরুরি। এতে শিক্ষার্থীদের অনলাইন অবব্যবহার কমবে। দুই. অনলাইনে সকল আয়ের শিক্ষার্থীদের সমান সুযোগ না থাকায় বৈষম্য হতে পারে। তাই ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস নিবন্ধন করিয়ে দেশের সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ দেয়া যেতে পারে। তিন. অনলাইনে শিক্ষা দান ও গ্রহণে অভ্যস্থতা না থাকায় কোনোরূপ ফলপ্রসূ ট্রেনিং ছাড়াই এ কার্যক্রম পরিচালিত হলে তাতে কার্যত কোনো ফল নিয়ে আসবে না।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতসহ প্রায় সব খাতে বিশাল ছাপ রেখেছে করোনা মহামারি। এ সংকটে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোই রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জটা আরো বড়ো। বিগত এক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেকাংশে এগিয়ে গেলেও করোনার কারণে অনেকটাই বাধাগ্রস্থ হয়েছে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। বিপুল জনসংখ্যার কারণে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও চ্যালেঞ্জ দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা সবচেয়ে বেশি এলোমেলো। এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির মাত্রা ও পরিমাণ অনেক। ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশ ছাড়া আরো ১৩টি দেশে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দেশের শিক্ষা সেক্টর জাতীয়করণ করা, শিক্ষায় ডিজিটালাইজেশন করাসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে চলতি বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি করেছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। অভিভাবকরা ভুগছেন সংকট ও আতঙ্কে। বহু কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও প্রাইভেট মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেছে। পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন বহু শিক্ষক। শুধু তাই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এসএসসি ও এইচএসসিতে তৈরি হয়েছে পরীক্ষাজট এবং উচ্চশিক্ষায় সৃষ্টি হয়েছে সেশনজট। এ ছাড়া নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বিভিন্ন ক্লাসে অটো প্রমোশন দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে সরকার অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করলেও তাতে সবার অংশগ্রহণ লক্ষণীয় নয়। বেশির ভাগ পরিবারে সন্তানদের অনলাইন ক্লাস উপযোগী স্মার্টফোন, ল্যাপটপ কিংবা প্রয়োজনীয় ডিভাইস কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। এ ছাড়া ইন্টারনেটের ধীরগতি এবং উচ্চমূল্য এই কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ। এ ছাড়া আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষকও এ ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত নন। ফলে উন্নত বিশ্বের মতো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের এখানে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করতে পারছে না।
করোনাকালের অভিজ্ঞতার নিরিখে কেমন হবে করোনা-পরবর্তী আগামীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা? বাস্তবমুখী ও কর্মমুখী আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি করতে হবে শিক্ষা কারিকুলাম স্বাস্থ্যনীতি। দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলামের পাশাপাশি বাস্তবমুখী নানা কার্যক্রমও কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। অনলাইনে আয় কিংবা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কোর্সগুলো কারিকুলামের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বই আরো যুগোপযোগী ও বিস্তৃত করে তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের দক্ষতায় দক্ষ করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে আরো সুদৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার জন্য মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আগামি দিনে যে কোনো প্রাকৃতিক বা মহামারিতে স্বাস্থ্যসেবায় কী ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হবে, তা এখনই চিন্তা করার সময় এসেছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জমাদি সহজলভ্য করা দরকার। প্রয়োজনীয় হাসপাতাল, বেড, আইসোলেশন ওয়ার্ড, প্রশিক্ষিত ও আভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্স নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সরকার নিঃসন্দেহে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ যাত্রা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয় আর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যেতো তবে এর দায়িত্ব কে নিত? তাই আসুন, তর্ক কিংবা দ্বিধা না রেখে শিক্ষার্থীদের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ও আগামীর বাংলাদেশ গড়তে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর অভিভাবকরাও চান ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারে আরো আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক ও সহজলভ্য হোক।
করোনা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অচলাবস্থার বিষয়টি সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তাই ভবিষ্যতে মূল বাজেটের শতকরা ১২ শতাংশ অথবা জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। এবং একইভাবে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করাসহ শিক্ষায় আধুনিকায়নে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনায় যে সমন্বয়হীনতা আছে, স্বাস্থ্য প্রশাসনের সমন্বয়, দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছতার মাধ্যমে তা দূর করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য জনশক্তি নিয়োগ করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদি এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ও সৎ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। করোনাকে ভয় নয়, বরং সচেতনতা ও আন্তরিকভাবে ব্যক্তিগত সুরক্ষা অবলম্বন করার মাধ্যমে আমরা ‘নতুন স্বাভাবিক জীবনে’ ফিরে যেতে সক্ষম হব, ইন-শা-আল্লাহ।
বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর। জীবন সদস্য- নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট।