নিজস্ব প্রতিনিধি: দ্বিতীয় স্বামী রফিকুলের দেওয়া বাড়িসহ জমি লিখে না দিয়ে তালাক দেওয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় মোসলেমার। সাড়ে চার বছরের শিশু সন্তান মোস্তাকিমকে হত্যার হুমকি দিয়ে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে এনে স্বামী ও তার লোকজন গত ২৭ জুন রাতে মোসলেমাকে হত্যার পর লাশ গুম করতে শরীর থেকে দু’ পা’ দু’ হাত ও মুন্ডু কেটে ধড় ইছামতী নদীতে ফেলে দেয়।
সরেজমিনে সোমবার সকালে সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী হাড়দ্দহ গ্রামের ভাঙার মুখ নামকস্থানে গেলে বাবর আলী বিশ্বাসের ছেলে রফিকুল ইসলামের বাড়িটি তালাবন্ধ অবস্থায় দেখা যায়। জানতে চাইলে রণি হোসেন, রুহুল আমিন, আল আমিন ও ইউপি সদস্য আব্দুল গণিসহ কয়েকজন জানান, রফিকুলের দ্বিতীয় স্ত্রী মোসলেমা এ বড়িতে কনো দিনও আসেনি।
তবে দ্বিতীয় স্ত্রী মোসলেমার নামে জমি লিখে দেওয়ার পর বাড়ি করে দেওয়ায় প্রথম স্ত্রী রাবেয়া ও ছেলে রাসেলসহ পরিবারের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এ নিয়ে বিরোধ হতো তাদের। তবে রফিকুল যেভাবে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নৃশংসভাবে খুন করেছে তার বিচার দাবি করেন তারা।
হাড়দ্দহ মাঝেরপাড়ার আমানত আলীর ছেলে আমজাদ হোসেন(৬৮) জানান, ২৭ জুন সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে রউফ চেয়ারম্যানের মোড়ে একটি মাইক্রোবাস থেকে নামে রফিকুল ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী মোসলেমা। সাড়ে ১৩ হাজার টাকা মাইক্রোবাস ভাড়া দেয় তারা। তাদের পাড়ায় মোসলেমার জন্য নির্মিত বাড়িতে প্রথমে ঢোকে রফিকুল। পরে যায় মোসলেমা। রাস্তা থেকে নামার সময় মোসলেমার জুতো ছিঁড়ে যায়।
ওইদিন তারা ঘরের মধ্যে ছিল। বিকেল ৫টার দিকে মোসলেমার বাবা ও মা ওই বাড়িতে এসে বাইরের দিক থেকে তালা মারা দেখলেও ভিতরে মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে তাকেসহ স্থানীয় লোকজনদের মেয়ের বিপদ সম্পর্কে অবহিত করেন। তারা আড়াই ঘণ্টা অবস্থান করে স্থানীয় চেয়রাম্যন ইসরাইল গাজীকে বিষয়টি অবহিত করে বাড়িতে চলে যান।
পরদিন সকালে মোমলেমার বাড়িতে ঢোকার মুখে পার্শ্ববর্তী একটি তালা গাছের নীচ থেকে পলিথিনে রাখা একটি কালো রং এর বোরখা দেখতে পান। ওই রোবখাটি মোসলেমার বলে তার মনে হয়েছিল। যেটা তিনি পুলিশ ও মোসলেমার বাবা ও মাকে জানিয়েছিলেন। তবে তিনি মনে করেন ২৭ জুন সন্ধ্যার পর প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। সে কারণে কাঁচা রাস্তা দিয়ে কোন লোকজনের চলাফেরা ছিল না বললেই চলে।
ওই ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া গামছা দিয়ে রফিকুল তার স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর অন্য লোকজনের সহযোগতিায় ইছামতী নদীর পাড়ে নিয়ে নৃশংসভাবে হাত, পা ও মুন্ডু কেটে ফেলা হয় বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।
আলীপুর ঢালীপাড়ায় গেলে মোসলেমার মা মোঃ শাহীদা খাতুন বলেন, আট বছর আগে মোসলেমার সঙ্গে লক্ষীদাড়ি গ্রামের নূর আলী গাজীর ছেলে মফিজুলের বিয়ে হয়। তিন বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় মফিজুল। এরপর দেড় বছরের ছেলে মোস্তাকিমকে নিয়ে মোসলেমা একবার বাপের বাড়ি ও একবার শ্বশুর বাড়িতে যাতায়াত করতো।
এরমধ্যে সে সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর বড় বাজার থেকে বিভিন্ন ধরণের কসমেটিকস সামগ্রী ভোমরা বন্দরের জাহাঙ্গীর মার্কেটের পাশে রফিকুল বিশ্বাসের দোকানসহ বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করতো। জমি ও বাড়ি করে দেওয়ার শর্তে দু’ বছর আগে ভালবেসে হাড়দ্দহ গ্রামের বাবর আলীর ছেলে রফিকুল (ভোমরার ব্যবসায়ি) সন্তানসহ মোসলেমাকে বিয়ে করে।
পরে মোস্তাকিমকে মেনে নিতে না পারায় তাকে তার (নানী) কাছে রেখে দেওয়া হয়। এরপর জমি ও বাড়ি করে না দেওয়ায় মোসলেমার সঙ্গে রফিকুলের ক্রমশঃ সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। একপর্যায়ে ২০১৯ সালের ৬ আগষ্ট রফিকুল তার নিজ নামীয় ১১ শতক জমি মোসলেমার নামে রেজিষ্ট্রি কোবালা দলিল(৫৬৭৭নং) করে দেয়। পরে মোসলেমাকে দু’কক্ষ বিশিষ্ঠ এসবেস্টার্স ছাউনি দিয়ে ঘর করে দেয়।
গত রমজানের এক সপ্তাহ আগে রফিকুলকে তালাক দিয়ে পুষ্পকাটির রেজাউলের সহায়তায় সৌদি আরবে যায় মোসলেমা। তালাক দিয়ে বিদেশ যাওযাট কে ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি রফিকুল। একপর্যায়ে রেজাউলের মাধ্যমে মোসলেমার মোবাইল নং যোগাড় করে ছেলেকে বাপের বাড়ি থেকে ধরে এন নৃশংসভাবে খুন করার হুমকি দেয়া হয়। ২৬ জুন বিকেলে মোসলেমা ঢাকা বিমানবন্দরে নামবে এমন খবরে আগের দিন ঢাকায় অবস্থান করে রফিকুল।
২৬ জুন বিকেল ৫টার পরপরই মোসলেমা ঢাকায় আসার পরপরই তাদের (শাহীদা)বাড়িতে অবস্থানকারি মোসলেমাকে বিদেশে পাঠানোর সহায়তাকারি রেজাউলের ফোনে তাদের কথা হয়। ২৭ জুন সকালে মোসলেমার সঙ্গে কথা বললে সে সাতক্ষীরায় আছে বলে জানায়। কয়েকবার কথা বলার একপর্যায়ে মোসলেমার কথা বেসুরো লাগায় বৃদ্ধ প্রতিবন্ধি স্বামীকে নিয়ে তিনি একটি ভ্যানযোগে ২৭ জুন বিকেল ৫টার দিকে হাড়দ্দহ মাঝেরপাড়ায় মোসলেমার বাড়িতে যান।
ওই বাড়ির দরজার বাইরে তালা লাগানো ছিল। তবে ঘরের মধ্যে মোসলেমার কান্নার আওয়াজ শুনতে পান তারা। সেখানে অবস্থানকারি দু’ যুবককে তারা দেখতে পেয়ে রফিকুলকে ডেকে বাইরে আসতে বললে উত্তর দিলেও সে আসেনি। এক পর্যায়ে সেখানে আড়াই ঘণ্টা অবস্থান করে মেয়ের বিপদের বিষয়টি ভোমরা ইউপি চেয়ারম্যান ইজরাইল গাজীকে জানিয়ে রাত ৯টার দিকে বাড়ি ফেরেন তারা।
অধিক রাতে মেয়ের বিপদের কথা প্রতিবেশী ও স্বজনদের জানালেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেউ রাতে সেখানে যেতে রাজি হয়নি। পরদিন সকালে তারা কয়েকজন যেয়ে ঘরের তালা ভেঙে মোসলেমাকে পাননি। দুপুরে দেবহাটার ভাতশালায় ইছামতী নদীতে হাত, পা ও মুন্ডু কাটা এক মহিলার লাশ পাওয়া গেছে এমন খবর পেয়ে সন্ধ্যায় শরীরে বিশেষ শ্বেতীর দাগ দেখে লাশ মোসলেমার বলে শনাক্ত করেন তিনি।
পরদিন পুলিশ হাড়দ্দহ ১নং পিলারের পাশ থেকে ও পার্শ্ববর্তী এক ব্যক্তির চিংড়ি ঘেরের আল থেকে মোসলেমার দু’টি কাটা পা উদ্ধার করে পুলিশ। তার মেয়েকে হত্যার পিছনে রফিকুল, তার প্রথম স্ত্রী রাবেয়া, জামাতা কুলিয়ার খাসখামারের সবুজ, পুষ্পকাটির রেজাউলসহ একটি মহল জড়িত বলে তিনি মনে করেন। বাড়িসহ জমি লিখে দিতে রাজী না হওয়ায় মোসলেমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। হত্যাকারিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান মোসলেমার পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সদর তানার উপপরিদর্শক মানিক সাহা সোমবার দুপুরে বলেন, এ মামলায় শাহীদা খাতুন বাদি হয়ে রফিকুলসহ ছয় জনের নাম উল্লে¬খ করে থানায় একটি হত্যা মামলা (জিআর-৪৪৮/২১)দায়ের করেছেন। রফিকুলের প্রথম স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান নিজেই মামলাটির তদারকি করছেন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হত্যার মোটিভ, হত্যার সঙ্গে কারা যুক্ত তাদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। মামলার বাইরে থাকা কয়েকজনকে সন্দেহের আওতায় রাখা হয়েছে।