আমার মেয়ের হাড্ডি ভিক্ষা দাও। হাড্ডি লইয়া দেশে যামুগা

দেশে নিয়া হাড়গুলো বুকে জড়িয়ে রাখমু।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এভাবেই মেয়ের ছবি বুকে জড়িয়ে বিলাপ করছিলেন বেল্লাল হোসেন। তার মেয়ে মিতু আক্তার (১৪) কাজ করতো হাসেম ফুডের কারখানায়। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে আর মিতুর খোঁজ মিলছে না। স্বজনদের ধারণা ঢাকা মেডিকেলে যাদের লাশ আনা হয়েছে তাদের মধ্যে মিতুর লাশও আছে। তবে পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোকেতো আর চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তাদের পরিচয় নিশ্চিতের চেষ্টা চলছে। শুধু বেল্লাল হোসেনই নন, ঢাকা মেডিকেলের মর্গ এলাকায় ভিড় করেন নিখোঁজ আরও অনেকের স্বজনেরা। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ।

বেল্লাল হোসেন বলেন, মিতু সকাল সাতটায় আমার কাছ থেকে দশটা টাকা নিয়ে যায়। আর আমার মেয়ে দশ টাকা চাইবে না। মেয়ের ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন, আমার মেয়ের কি সুন্দর ছবি। কিন্তু মেয়ে পুড়ে কয়লা হয়ে কই আছে। সে নিখোঁজ। তার কঙ্কাল পড়ে আছে কই?  বেল্লাল হোসেন বলেন, আমার মেয়ে ক্লাস এইটে ওঠার পরে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। স্কুল বন্ধ থাকায় সে চাকরিতে যায়। আঠারো বছর ধরে ঢাকায় থাকি। আমার মেয়ে বলে, আব্বা আমার কোনো ভাই নেই। আমরা দুই বোনে যদি কিছু কামাই করে টাকা দিতে পারি তোমার কিছুটা অভাব কমবে। তোমার তো ইনকাম করতে কষ্ট হয়। আমরা দুই বোন চাকরি করি। স্কুল খুললে আবার ছেড়ে দিব। দুই বোনে চাকরি করলে তোমার অভাব থাকবে না। টাকা গুছিয়ে আমরা একেবারে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবো।

তিনি আরও বলেন, মেয়ে আমার তিনমাস ধরে কাজে লাগছে। দুই মেয়ে একসঙ্গে সেজানে কাজ করতো। মেয়েরা ভেবেছিল কিছু টাকা পেলে কেনাকাটা করে বাড়িতে চলে যাবো।  বেল্লাল জানান, তার তিন মেয়ের মধ্যে মিতু ছিল দ্বিতীয়। ছোট মেয়ের বয়স আড়াই বছর। বড় মেয়ে খাদিজা আক্তারও সেজানে চাকরি করতেন। নাইট ডিউটি থাকায় বাসায় ছিলেন। মাসে পাঁচ হাজার তিনশত টাকা বেতন ছিল মিতুর।

বেঁচে ফেরা পারভীন খুঁজে ফিরছেন মেয়ের লাশ:
‘মাইয়া কই গেল আমার। মাইয়ার জীবন পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমার মেয়েটার শরীরে আগুন লাগছে। কী না জানি করছে মাইয়া আমার। ও মা তুই কই? বুকটার মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে।’ মেয়ে তাসলিমা আক্তারের (২০) লাশ শনাক্তের জন্য নমুনা দিতে এসেছিলেন মা পারভীন বেগম। সঙ্গে ছিল তার স্বামী বাচ্চু মিয়া। মেয়ের সঙ্গে মা চাকরি করতেন ওই ভবনের ২য় তলায়। চারদিকে আগুনের শিখা দেখে জীবনের ভয় না করে নিচে লাফিয়ে পড়ে বেঁচে যান তিনি। নিজের শরীরের ব্যথা ভুলে মর্গের সামনে অঝোরে কাঁদছেন তিনি।

পারভীন বেগম বলেন, দুইতলায় বসে প্রথমে দেখি আগুন। তখন বিকাল চারটা বাজে। সবাই ছোটাছুটি করছে। আগুন লাগছে, আগুন লাগছে বলে চিৎকার করছে। পরে চারতলায় নসিলা সেকশনে মেয়ের কাছে যাইতে চাইছি। আগুনের জন্য আর পারিনি। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করি। নামতে পারি না। তারপর দেখি অনেকে বাঁচার জন্য লাফিয়ে পড়ছে। আমিও রাস্তায় জুসের গাড়িতে লাফিয়ে পড়ি। দশ মিনিটের মধ্যে আমার কি হয়েছে কিছুই বুঝিনি। দশ মিনিট পরে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। তখন আমি আমার মেয়েকে খুঁজছি। দেখি কোথাও নেই। মেয়ে তার স্যার, ম্যাডামদের সঙ্গে ছিল চারতলায়। তারাও নামে না। আমার মেয়েও নামে না। লাফিয়ে পড়ার আগে আমার জীবনের ভয় ছিল না। ছিল আগুনের ভয়। আমার সঙ্গে মিনা নামে একজন লাফিয়ে পড়ে। সে গাড়িতে না পড়ে রাস্তায় পড়ার কারণে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। সেও আমার সঙ্গে দুই তলায় ললিপপ সেকশনে কাজ করতো।

তিনি আরও বলেন, আমি আর আমার মেয়ে তাসলিমা আক্তার একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার কাজে গিয়েছি। এটা বুঝি আমার শেষ খাওয়া ছিল। বুকে ও মাথায় আঘাত পেয়েছি। মনে হচ্ছে বুকটার মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে। একদিকে মেয়ের শোক, অন্যদিকে শরীরের ব্যথা। আমার মেয়ের তারপর থেকে আর কোনো খবর নেই।

নিহত তাসলিমার বাবা বাচ্চু মিয়া জানান, আগুন লাগার পরে তার স্ত্রী লাফিয়ে পড়ার পর একজনের মোবাইল দিয়ে ফোন দেয়। তারপর ছুটে আসি। মানুষের হাত-পা ধরে বাবা, মা ডেকে আমার মেয়েটাকে খুঁজে দিতে বলেছি। কেউ ডাকে সাড়া দেয়নি। আমার মেয়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। আর ফিরে আসবে না। ঘটনার দিন মেয়েটা অফিসে যাওয়ার আগে আমার কাছ থেকে বিশ টাকা রিকশা ভাড়া নিয়ে বলে বাবা অফিসে যাচ্ছি।

তিনি আরও জানান, তিন বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান। গ্রামের বাড়ি কিশোরঞ্জ। রামগঞ্জের গোলাকান্দাইলে স্ত্রী ও পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকেন তিনি। সংসারে অভাব থাকায় তার স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে চাকরি করতেন। মেয়ে তাসলিমা পাঁচহাজার টাকা বেতনে চাকরি করতো। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সে ছিল বড়। বাকি দুই ছেলে-মেয়ের ওইদিন রাতে ডিউটি থাকায় তারা বাসায় ছিল।
আমার আম্মুকে এনে দাও: সোমা আক্তার বাস্তবতা বুঝে ওঠার আগেই হারাতে হয়েছে তার মা অমৃতা বেগমকে। মায়ের ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে মেডিকেলের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাত্র সাত বছরের শিশুটি নির্বাক চোখে মা’কে খুঁজছে। কিন্তু কোথাও নেই মায়ের দেখা। কাঁদতে কাঁদতে সোমা আক্তার বলছে, আগুনের কথা শুনে মা’কে খুঁজতে আসছি। সারাদিন শুধু মায়ের জন্য কান্না করতেছি। আম্মুকে দেখতে আসছি। কিন্তু আম্মুকে তো পাই না। আমার আম্মুকে এনে দাও।

নিহত অমৃতা বেগমের ছোট বোন রোজিনা জানান, সকালে দুই বোন একসঙ্গে ডিউটিতে আসি। দুই বোন দুই সেকশনে চাকরি করতাম। বিকাল চারটায় আগুন লাগে। তখন আমাদের স্যাররা বলে ওঠেন আগুন লাগছে। পরে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি অনেক আগুন। তারপর আমরা মেশিন বন্ধ করে নিচে নেমে গেছি। নিচে নেমে দেখি শত শত শ্রমিক বাইরে বেরিয়েছে। কিন্তু আমার বোন নাই কোথাও। তারপর আবার গেটের দিকে যাই। দেখি সেখানেও আমার বোন নেই। সবার কাছে অনেক চিল্লাপাল্লা করি আমার বোনকে বাঁচানোর জন্য। বলি শ্রমিকগুলোকে বাঁচান। পরে দেখি গেটে তালা দিয়ে দিছে। চারতলা বন্ধ। পাঁচতলার মানুষ ছাদে উঠে গেছে। তিনতলার মানুষ লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খুঁজেছি বোনকে। কিন্তু কোথাও পায়নি। অনেককে বললাম আমার বোন এই চারতলার সেকশনে কাজ করে। আমার বোনটারে খুইজ্জা দেন। গেটে তালা মারা ছিল। এজন্য কেউ বাঁচতে পারে নাই। গত মাসের এক তারিখ থেকে  সে কাজে যোগ দিয়েছিল। পাঁচ হাজার টাকা বেতনে কাজ করতো।
তিনি আরও বলেন, সকালে মেয়েকে ঘুমিয়ে রেখে অফিসে আসছে তার বোন অমৃতা। এই এতিম মেয়ের জন্য বিচার চাই। আমার বোন চাই। আমার বোনকে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটা এতিম হয়ে গেল। এই বাচ্চাটাকে আমি কি দিয়ে বুঝাবো।

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।