আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস আজ নিখোঁজদের ফিরে আসার অপেক্ষায় স্বজনরা

নাছির উদ্দিন শোয়েব : সাদা পোশাকে তুলে নেয়ার পর এখনো অনেকের খোঁজ মেলেনি। এরমধ্যে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ছাড়াও সমাজের উচ্চস্তরের ব্যক্তিও রয়েছেন। নিখোঁজ হওয়ার পর কেউ কেউ ফিরেও এসেছেন। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। নিখোঁজ ব্যক্তিকে ফিরে পেয়ে স্বজনরা খুশি হলেও কেন বা কি ভাবে কারা এ ঘটনা ঘটলো তা অজানাই থেকে যায়।  তবে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের অভিযোগ- অনেকেই আর ফিরে আসেনি। দিনের পর দিন তারা অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছেন। স্ত্রী, সন্তান-বাবা-মা এবং স্বজনরা এখনো পথ চেয়ে আছেন প্রিয় মানুষটির ফিরে আসার অপেক্ষায়। এভাবেই দিন থেকে মাস, বছর চলে গেলেও প্রিয় মানুষটি আর বাড়ি ফিরে আসছে না। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ থেকে ২০২০ (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ৬০৪ জন গুম হয়েছে।
সর্বশেষ আট দিন নিখোঁজ থাকার পর সন্ধান মিলে আলোচিত ইসলামী বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান ও তার সাথে থাকা চারজনের। গত ১৮ জুন বিকেলে তার খোঁজ পাওয়া যায়। সেদিন বিকেল ৩টার দিকে তাকে রংপুুুর নগরের আবহাওয়া অফিস সংলগ্ন মাস্টার পাড়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এর আগে গত ১০ জুন রংপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে ইসলামী বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান নিখোঁজ হন। ত্ব-হার নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানিয়ে রাজধানীর দারুসসালাম এবং মিরপুর থানায় গেলে কোনো থানাই সাধারণ ডায়েরি বা মামলাগ্রহণ করেনি বলেও অভিযোগ করেছে তার পরিবার। এ নিয়ে সর্বশেষ রংপুর সদর থানায় একটি জিডি করা হয়। তবে ফিরে আসলেও তার নিখোঁজের বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি।
এরই মধ্যে দিয়ে আজ সোমবার ৩০ আগস্ট বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর ৩০ আগস্ট গুম হওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ এবং সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য দিবসটি পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীর পাশাপাশি আছে সাধারণ লোকজনও। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বন্ধ না হলেও অনেকটাই কমেছে। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেছেন, বাংলাদেশে গত বেশ কয়েক দশক ধরে একের পর এক গুমের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এটি বন্ধ করার জন্য দৃশ্যমান কোনও পদক্ষেপ আমরা লক্ষ্য করিনি। গত এক দশক ধরে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কখনোই বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। জাতিসংঘের এই চিঠি অবশ্যই একটা অগ্রগতি।
এদিকে গুম বা নিখোঁজের বিষয়ে সম্প্রতি জাতিসংঘ থেকে হঠাৎ বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে। এরপর  আবারও বিষয়টি সামনে আসে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ৩৪ জনের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। ইতিমধ্যে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠি পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদিকে ৩৪ জন ব্যক্তির গুমের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদকে জবাব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
এর আগে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, গত ১৪ বছরে দেশে ৬০৪ জনকে গুম করা হয়েছে। সব গুমের অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গুমের শিকার সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা, প্রতিটি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছে। একইসঙ্গে গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করে গুম প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০২০ (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছে। অন্যদের বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়নি।
এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সাংবাদিক বা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, বিশেষ বাহিনী-র‌্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। প্রায়ই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। পরিচিত কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং উদ্ধারের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনও মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় বা ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। যারা ফিরে আসতে পেরেছেন তাদের ক্ষেত্রেও কী ঘটেছে তা জানা যায় না।
এদিকে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ৩৪ জনের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। ওই চিঠির সূত্র ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১৪ জুন পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) একটি চিঠি পাঠায়।  জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলরের ওয়ার্কিং গ্রুপের পাঠানো গুম হওয়া ৩৪ জনের বিস্তারিত পরিচয় ও তাদের গুম হওয়ার সময়কার বর্ণনা এবং এ সংক্রান্তে থানা পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে অভিযোগ দেওয়ার বিস্তারিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা হলেন- সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী, বিএনপি নেতা মো. ইলিয়াস আলী, মোহাম্মদ চৌধুরী আলম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আরমান আহমদ বিন কাসেম, আনসার আলী, সাজেদুল ইসলাম, মোহাম্মদ আব্দুল কাদের ভূঁইয়া, মো. কাউসার হোসেন, মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, আল আমীন, সোহেল রানা, মোহাম্মদ হোসেন চঞ্চল, পারভেজ হোসেন, মো. মাহফুজুর রহমান, জহিরুল ইসলাম, নিজাম উদ্দিন, মাহবুব হাসান সুজন, কাজী ফরহাদ, সম্রাট মোল্লা, তপন দাশ ওরফে তপু, কে এম শামীম আক্তার, খালেদ হাসান সোহেল, এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন, মো. হাসিনুর রহমান, রাজু ইসলাম, ইসমাইল হোসেন, মো. তারা মিয়া, মোহাম্মদ নূর হোসেন, মোহন মিয়া, ইফতেখার আহমেদ দিনার, কেইথিলপাম নবচন্দ্র, সেলিম রেজা পিন্টু ও জাহিদুল করিম। এ ছাড়াও হাফেজ জাকির হোসাইন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা আল মোকাদ্দাস ও মোহাম্মদ ওলিউল্লাহ প্রমুখের নাম রয়েছে এ তালিকায়।
এরআগে দেশে ৩৪ জন ব্যক্তির গুমের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদকে জবাব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশে এখনো ৮৬ জন গুম হয়ে আছেন। এ বছরের ১৬ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ বলেছে, তারা মনে করে, জাতিসংঘের উচিত গুম নিয়ে একটি স্বাধীন তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া। প্রতিবেদনে গুমের জন্য বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে দায়ী করা হয়েছে। জুলাই ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত মোট ১১৫টি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এইচআরডব্লিউ ‘নো সান ক্যান এন্টার: আ ডিকেড অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

Check Also

তালায় ইউপি পরিষদ কক্ষে দুই সাংবাদিকের উপর হামলা, প্রতিবাদে মানববন্ধন

তালা প্রতিনিধি তালার ইসলামকাটি ইউনিয়ন পরিষদে সাংবাদিক আক্তারুল ইসলাম ও আতাউর রহমানের ওপর সন্ত্রাসী রমজান আলী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।