অসময়ের সবোর্চ্চ বৃষ্টিপাতে বিপর্যস্থ সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণাঞ্চল

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূল অঞ্চলে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অসময়ের সবোর্চ্চ বৃষ্টিপাতে সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণাঞ্চল বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে়ছে। ঘুর্ণিঝড় ইয়াছে ক্ষতিগ্রস্থ পোল্ডারের ভেতর জোয়ারের পানি অবাধে ঢুকে পড়ায় এলাকায় বসবাস করা লোকজনের পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠেছে। আইলা, সিডর,আম্পানের সময় ক্ষতিগ্রস্থ পোল্ডারগুলোর সংস্কার শেষ না হওয়ায় অনেক বাস্তুচ্যুত মানুষ এখনো ঘরে ফিরে আসতে পারেনি। এ বছর অস্বাভাবিক জোয়ার ও টানা বৃষ্টিতে উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে সাতক্ষীরা জেলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বহু জায়গায় পোল্ডার ভেঙে বা উপচানো পানি ঢুকে বিস্তীর্ণ এলাকা মাসের পর মাস জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। লোকজনকে ঘরবাড়ি ছেড়ে বাঁধ ও রাস্তায় আশ্রয় নিতে হয়েছে। অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে তাদের দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। অনেকেই জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে। এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে পরিবেশ বিপর্যয়, ধানের পরিবর্তে চিংড়ি চাষ, কল-কারখানা গড়ে না উঠা, আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে মন্দাভাব ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারায় জেলায় বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। নতুন করে প্রবল বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা জেলা বাসির কাছে যেন ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হয় দাড়ালো।

সাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপের প্রভাবে সাতক্ষীরায় সবোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গত ১৮ অক্টোবর সকাল ৬ থেকে ১৯ অক্টোবর সন্ধা পর্যন্ত টানা বর্ষণে সাতক্ষীরা শহর, সদর, তালা, কলারোয়া, আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। ভেসে গেছে জমির ফসল, আমন বীজতলা, মাছের ঘের ও পুকুর। সাতক্ষীরার সদর উপজেলার ধুলিহর, ফিংড়ি, ব্রহ্মরাজপুর, লাবসা, বল্লী, ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের অধিকাংশ বিলগুলোতে সদ্য রোপা আমন ও বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। শতাধিক মাছের ঘের ও পুকুর ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, নিম্নচাপের সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী দুদিন এভাবে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে বলে জানান তিনি।
জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হলো উপকূলীয় পোল্ডার। বেশির ভাগেরই বয়স ৫০-৬০ বছরের বেশি। এগুলো মাটির তৈরি হওয়ায় এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব পোল্ডার করার পর থেকে নদীগুলোতে ব্যাপক হারে পলি পড়তে শুরু করে।১৯৮০ এর দশকে চিংড়ি চাষ শুরু হওয়ার পর অঞ্চলটির পরিবেশের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। বহু এলাকা ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়তে থাকে। উপকূল অঞ্চল মূলত ধান চাষ, মাছের উন্মুক্ত প¬াবনভূমি এবং গবাদিপশুর চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। চিংড়ি চাষের জন্য লবণাক্ত পানি ঢোকানোর ফলে আগের ভূমি ব্যবহার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সব গাছপালা মরে গিয়ে এলাকা বিরানভূমির রূপ নেয়।এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। ফলে কাজের খোঁজে এবং এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় অনেকেই শহরমুখী হতে বাধ্য হয়েছে।
জেলার বেশির ভাগ বাঁধই ব্যবহারের অনুপযোগী। উপকূলের বহু অঞ্চলে জলকপাটগুলো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। জলকপাটগুলো অচল হয়ে পড়েছে।পোল্ডারের ভেতরের মৃতপ্রায় নদী, খাল, বিল ইত্যাদি পুনঃখনন করে সচল করা দরকার, যাতে জলাবদ্ধ পরিস্থিতি না হয়। নদী ও খালে মাছ চাষের জন্য সব বাধা উচ্ছেদ করে সারা বছর সেসব সচল রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে সংশ্লিষ্টরা দাবী জানিয়েছে।বিশেজ্ঞরা বলছে, উপকূলীয় ভূমি ব্যবহার প্রকৃতিবান্ধব হওয়া প্রয়োজন। ধান, মাছ ও গবাদিপশু এই তিনের মিশ্রণে ভূমির ব্যবহার প্রয়োজন। যেখানে যা প্রযোজ্য, সেখানে তা–ই করা দরকার। প্রাকৃৃতিকভাবে যেখানে চিংড়ি চাষ সম্ভব, শুধু সেখানেই তা করতে দেওয়া উচিত। জোর করে লবণপানি পোল্ডারের ভেতরের আবাদি জমিতে ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ সর্বতোভাবে পরিহার করা দরকার।গবেষণায় দেখা গেছে, এভাবেই চলতে থাকলে, অর্থাৎ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাবে এবং সেখান থেকে অন্যত্র চলে যাওয়া ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকবে।
উপকূলীয় অঞ্চলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে জনজীবনে সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এরপর করোনা পরিস্থিতি এবং সুপার সাইক্লোন আম্ফান ও ইয়াসের আঘাত সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এই সংকট দেখা দিলেও এখন স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই উপকূলের বিস্ত্রর্ণী এলাকা প¬াবিত হচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: নুরুল ইসলাম বলেন, এই বৃষ্টি ৭১০ হেক্টর আমনের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া ১০২ হেক্টর শাক-সবজির ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে পরশু দিন থেকে বৃষ্টিপাত কমতে পারে। সেক্ষেত্রে এই বর্ষনে কৃষির উপর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলে জানান তিনি।উপকূলকে বসবাসের উপযোগী রাখার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: ১৯/১০/২০২১

Please follow and like us:

Check Also

২৮শে এপ্রিল খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবারেও ক্লাসের পরিকল্পনা

আগামী ২৮শে এপ্রিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সব রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।